উত্তরপশ্চিম চীনের নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত পশ্চিম সিয়া রাজাদের সমাধির প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান হলো বিংশ শতাব্দিতে চীনের ১০০টি বিরাট প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের অন্যতম। এটা চীনের সংখ্যালঘু জাতির প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
৭৭০ বছর আগে চীনে একই সঙ্গে তিনটি রাজবংশ বিরাজমান ছিল অর্থাত্ “ সোং”, “লিয়াও” এবং “পশ্চিম সিয়া” রাজবংশ । হান জাতির সোং রাজবংশের আওতা ছিল চীনের মধ্য সমতলভুমি ও দক্ষিণচীন জুড়ে । খিতান জাতির লিয়াও রাজবংশের আওতা চীনের উত্তরপূর্ব অংশ জুড়ে । তাংগুত জাতির “মহা সিয়া” অর্থাত্ “ পশ্চিম সিয়া” রাজবংশের আওতা ছিল চীনের উত্তরপশ্চিম অংশ জুড়ে ।
স্বাধীন রাজ্য “পশ্চিম সিয়া”র নিজস্ব ভাষা ও লিপি ছিল । দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, ১২২৭ খৃষ্টাব্দে মঙ্গোলিয়ার চেংগিসখানের বিরাট বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিম সিয়া জয় করার পর পশ্চিম সিয়ার তুংগুত জাতির জনগণকে নিধন করার জন্যে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, ফলে পশ্চিম সিয়া রাজবংশের বইপুস্তক আর নথিপত্র সবই ধুলিসাত হয়ে গেছে । শৌর্যময় পশ্চিম সিয়া রাজবংশ পরবর্তী যুগের লোকদের জন্য রেখে গেছে শুধু একটির পর একটি ধাঁধা।
গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে পশ্চিম সিয়া রাজাদের সমাধির ধ্বংসাবশেষ অবলীলাক্রমে আবিষ্কৃত হয় । তার পর ৩০ বছরে চীনের পুরাকীতি বিষয়ক প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই সমাধি নিয়ে অনেকবার তদন্ত , জরীপ এবং খনন কাজ চালিয়েছেন। তাতে প্রাথমিকভাবে পশ্চিম সিয়া রাজবংশের সমাধির অবস্থান এবং কাঠামো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে।
পশ্চিম সিয়া রাজবংশের সমাধিস্থানের মোট আয়তন ৫০ বর্গকিলোমিটার , তাতে মোট ৯ জন রাজার সমাধি এবং ২৫০ টি অভিজাত ব্যক্তির সমাধি রয়েছে । এতো বড় এবং এতো ভালভাবে ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষিত রয়েছে --এমন রাজকীয় সমাধি চীনে বেশি নেই । এর আয়তন পেইচিংয়ের মিং রাজবংশের ১৩ জন সম্রাটের সমাধির কাছাকাছি । পশ্চিম সিয়া বংশের ৯টি রাজার সমাধির প্রত্যেকটিই একটি স্বতন্ত্র আর পূর্ণাঙ্গ স্থাপত্যমণ্ডল । মহিমাময় , প্রকাণ্ড আর ভাবগম্ভীর প্রতিটি সমাধি দক্ষিণমুখী । প্রত্যেক সমাধিই সমকোণী চতুর্ভূজাকার।
৯টি রাজকীয় সমাধির মধ্যে তিন নম্বর সমাধি সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত । প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে , এটা সম্ভবত পশ্চিম সিয়া রাজবংশের প্রথম রাজা লি ইউয়ান হাও-এর সমাধি । ৯টি সমাধির মধ্যে প্রধানত এই তিন নম্বর সমাধিতেই প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানো হয়েছে ।
পশ্চিম সিয়া রাজবংশের সমাধির প্যাগোডাগুলোকে “ প্রাচ্যের পিরামিড” বলে প্রশংসা করা হয়। প্রতিটি প্যাগোডা প্রত্যেক রাজার সমাধিস্থানের উত্তরপশ্চিম কোণে এবং কবরের ঠিক পিছনদিকে অবস্থিত । বর্তমানে প্যাগোডা যে অবস্থায় রয়েছে, তার ব্যাস ( বৃহত্তম প্যাগোডার ব্যাস) ৩৪ মিটার, প্যাগোডার ভিত্তি বেশ মজবুত , বড় এবং উঁচু । প্যাগোডা আট কোণ-বিশিষ্ট । প্যাগোডার ভিত্তির ওপর আরও ৭ বা ৫ তলা আছে, এখন সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন । তবে প্যাগোডার নিচের তলা বড়, উপরের তলাগুলো ক্রমেই ছোট হয়ে যায়। প্যাগোডাগুলো হলো পশ্চিম সিয়া রাজবংশের সমাধিস্থানগুলোর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপত্য। এই রকম স্থাপত্য -শৈলী চীনের অন্যান্য অঞ্চলে দেখা যায় না, এতে পশ্চিম সিয়া রাজবংশের রাজা এবং অভিজাত শ্রেণীর সমাধির বিশেষ রীতিনীতি প্রতিফলিত হয়।
২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল প্রত্নতত্ত্বকর্মীরা ৩ নম্বর সমাধির খননকাজ চলাকালে একটি সমাধিস্থানের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি মানুষের মুখ এবং পাখির শরীর-বিশিষ্ট মূর্তি আবিষ্কৃত করেছেন এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা এটাকে “ পক্ষিমানব” বলে আখ্যায়িত করেছেন। বৌদ্ধসূত্র অনুযায়ী এটা এক দৈব পাখি, যা নাকি হিমালয়পর্বতে থাকে এবং খুব শ্রুতিমধুর গান গাইতে পারে । এটা বৌদ্ধ ধর্মের ‘চিরানন্দলোকের’ এক রকম দৈব পাখি। তার মূর্তি চীনের বৌদ্ধ মন্দিরের ওপরে কারুকার্য হিসেবে স্থাপিত থাকে ।
পশ্চিম সিয়া বংশীয় সমাধি স্থানের খননকাজ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার ( ঘরের চালের প্রান্তস্থ) বিশেষ টালি এবং স্থাপত্য সাজানোর জন্য ব্যবহৃত দুটো কারুকাজ এবং অন্যান্য পুরাকীর্তি নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, পশ্চিম সিয়া রাজবংশীয় সমাধির স্থাপত্যশৈলীতে যেমন গৃহিত হয়েছে চীনের প্রাচীন হান জাতির রাজকীয় সমাধির বিশিষ্ট সত্গুণ, তেমনই তার ওপর বৌদ্ধ স্থাপত্যবিদ্যার প্রবল প্রভাবও পড়েছে। আসলে পশ্চিম সিয়া রাজবংশের সমাধির স্থাপত্যশৈলীতে তিনটি উপাদানের সমন্বয় সাধিত হয়েছে, এই তিনটি হলো: (চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ)হান জাতির সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সংস্কৃতি এবং পশ্চিম সিয়া বংশের তাংগুত(তাংসিয়াং) জাতির সংস্কৃতি । তিনটি মিলে চীনা সমাধি-স্থাপত্যের বিশেষ এক অভিনব শৈলী গড়ে উঠেছে। এটি চীনের সমাধির স্থাপত্যশিল্প উন্নয়নের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। পশ্চিম সিয়া রাজবংশীয় সমাধিগুলোর খননকাজ থেকে আবিষ্কৃত প্রচুর পরিমাণ পুরাকীর্তি নিদর্শনে কেন্দ্রীভূতভাবে পশ্চিম সিয়া রাজবংশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং পশ্চিম সিয়া সংস্কৃতির মহাভাণ্ডার দেখানো হয়েছে । তাতে প্রতিফলিত হয়েছে পশ্চিম সিয়া আমলের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং বিশেষ স্থাপত্য শৈলী। এ সবই অমূল্য পুরাকীর্তি নিদর্শন।
|