‘ইন ধ্বংসাবশেষ’ এবং কচ্ছপের খোল ও হাড়ের ওপর লিপি

      চীনা সভ্যতার ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে কয়েক হাজার বছর স্থায়ী । চীনে মাটির নিচে প্রাচীন সংস্কৃতির তথ্যসমৃদ্ধ অনেক লুপ্তাবশেষ পাওয়া গেছে। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব পাশ্চাত্য থেকে চীনে প্রসার লাভের পর চীনদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । 

  মধ্যচীনের হোনান প্রদেশের আনইয়াং শহরে আছে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন-বিশিষ্ট একটি প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ ।এটা বিশ্ব-বিখ্যাত ‘ ইন ধ্বংসাবশেষ’ । ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, খৃষ্টপূর্ব ১৪ শতাব্দীতে শাং বংশের রাজা ফানকেং শাং বংশের রাজধানী শানতোং প্রদেশের ছুফু থেকে এখানে স্থানান্তরিত করেছেন, তার পর প্রায় তিন শো বছরে এখানে বরাবরই শাং রাজবংশের রাজনৈতিক , সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল । খৃষ্টপূর্ব ১০৪৬ সালে চৌ রাজবংশের উ ওয়াং রাজা শাং বংশের সর্বশেষ জৌ রাজাকে পরাজিত করেন এবং তাতেই শাং রাজবংশের অবসান ঘটে । এই জায়গা একটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। এই শাং রাজবংশ আবার ইন রাজবংশ নামেও পরিচিত ছিল বলে এই জায়গাটি “ ইন ধ্বংসাবশেষ” নামে সুপরিচিত হয়। 

(ছবি: ইন ধ্বংসাবশেষ)

  ইন বংশের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার ও খনন ছিল বিংশ শতাব্দীতে চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার । ১৯২৮ সালে এই ধ্বংসাবশেষটিতে প্রথমবারের মতো খননকাজ শুরু হবার পর থেকে এখানে মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রচুর পুরাকীর্তি নিদর্শন । কচ্ছপের খোল ও হাড়ের ওপর প্রাচীন চীনা ভাষার লিপি, ব্রোঞ্জ পাত্র বা জিনিসপত্র ইত্যাদি । এর মধ্যে কচ্ছপের খোল ও হাড়ের ওপর লিখিত প্রাচীন চীনা ভাষার লিপির আবিষ্কার হলো বিশ্বের প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।  

(ছবি : “ইন ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত কচ্ছপের খোলে প্রাচীন লিপি)

  কচ্ছপের খোলে বা পশুর হাড়ে খোদিত হয় এক রকম প্রাচীন চীনা ভাষার লিপি । শাং রাজবংশের রাজার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আগেই গণকের দ্বারা কচ্ছপের খোলে বা পশুর হাড়ে ভবিষ্যদ্বাণী লেখানো হয় । 

  কচ্ছপের খোল বা পশুর হাড় এই কাজে ব্যবহার করার আগে যথাযথভাবে প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। অর্থাত্ খোল আর হাড় চেঁছে তার ওপর থেকে মাংস আর রক্ত সাফ করতে হয়। তার পর কচ্ছপের খোলের ভেতরের দিকে বা পশুর হাড়ের ওপর ছুরি , ইত্যাদি হাতিয়ার দিয়ে সেগুলোর ওপর কিছু না কিছু ফুটো সৃষ্টি করা হয় । এই সব ফুটো সাধারনত সুশৃংখলভাবেই থাকে । এই কাজ পরিচালনাকারী ব্যক্তিকে গণক বা ওঝা বলা হয়। তিনি তাঁর নিজের নাম, ভবিষ্যদ্বাণী করার অনুষ্ঠানের দিনতারিখ, জানার জন্য বিশেষ বিশেষ প্রশ্ন ইত্যাদি কচ্ছপের খোলে বা হাড়ে খোদাই করেন । তার পর এই কচ্ছপের খোল আর হাড় আগুনে সেঁকেন । যদি ফুটোগুলোতে তাপ লেগে কচ্ছপের খোল বা হাড়ে ফাটল বা চিড় ধরে, তাহলে সেগুলোকে “লক্ষণ” বলা হয়। এই সব চিড় বা ফাটলের আকৃতি বিশ্লেষণ করে গণক তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করেন । তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে কীভাবে ফলেছে , সে সম্পর্কেও খোলে বা হাড়ে খোদাই করে লিপিবদ্ধ করেন। এই সব লিপিসম্পন্ন কচ্ছপের খোল বা হাড় সরকারী বা রাজকীয় আর্কাইভ হিসেবে সংরক্ষিত রাখা হয়। 

  এ-পর্যন্ত ইন (বংশের) ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে এ জাতীয় ১.৬ লাখ পিস কচ্ছপের খোল আর পশুর হাড় । ওগুলোর ওপর লিপি আছে, অবশ্য কোনো কোনো হাড় বা খোলে কোনো লেখা নেই । কোনো কোনো কচ্ছপের খোল আর হাড় আগে থেকেই ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। এই সবগুলোর ওপর রয়েছে মোট চার হাজারের বেশি চিত্রাক্ষর । পণ্ডিতরা তার মধ্যে তিন হাজার চিত্রাক্ষর নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এক হাজারেরও বেশি চিত্রাক্ষর সনাক্ত করতে পেরেছেন । সনাক্ত চিত্রাক্ষরের সংখ্যা সীমিত হলেও আমরা সেগুলোর মাধ্যমে মোটামুটি শাং রাজবংশ আমলের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রের অবস্থা জানতে পেরেছি । প্রাচীনকালের এই বিশেষ লিপি গবেষণাকারীদের মধ্যে লিউ ও সবার আগে অর্থাত্ ১৯১৩ সালে একটি বিশেষ গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেন । বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং সাহিত্যিক কুও মোরুও ১৯২৯ সালে “ কচ্ছপের খোল ও হাড়ে খোদিত লিপি গবেষণা” নামক একটি বই প্রকাশ করেন । এটিও একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ । বর্তমান কালে এই বিশেষ লিপি গবেষণাকারীদের মধ্যে দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । একজন হলেন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার ছিউ সিকুই , অন্য জন হলেন চীনের ইতিহাস গবেষণালয়ের প্রফেসার লি সুয়েছিন । 

  শুধু শাং রাজবংশের আমলের এই সব কচ্ছপ ও হাড়ে খোদিত লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে তা নয়, উপরন্তু পশ্চিমচৌ আমলের প্রাচীন কচ্ছপের খোল ও পশুর হাড়ে খোদিত লিপিও আবিষ্কৃত হয়েছে, তবে তাতে লিপিবদ্ধ সাহিত্য রচনার সংখ্যা খুবই কম বলে তা কম গুরুত্বপূর্ণ । ইন(অর্থাত্ শাং) বংশের ধ্বংসাবশেষ খননকাজে শুধু যে এই প্রাচীন লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে তা নয় , উপরন্তু এখানে ৭০ বছর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালানোর পর প্রাসাদ ও মন্দির ইত্যাদি স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের ৫০টি নিদর্শন , ১২টি রাজার সমাধি এবং হাজার হাজার অভিজাত ও সাধারণ মানুষের কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া আরও আবিষ্কৃত হয়েছে ১০০টি যজ্ঞাগ্নির কুণ্ড, হস্তশিল্পের ৫টি কারখানা , মাটিতে গাড়ী ও ঘোড়া পুতে রাখার ৩০টিরও বেশি গর্ত এবং প্রচুর পরিমাণ ব্রোঞ্জপাত্র, জেড পাথরের শিল্পকর্ম, চীনা মাটি ও হাড়-জাত দ্রব্য। এই সবকিছুতে ফুটিয়ে তোলা হয় প্রাচীন চীনা সমাজের এক জীবন্ত রূপ।