ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী চীনের প্রাচীন শাসকরা সঙ্গীতচর্চার ওপর গুরুত্ব দিতেন । তাঁরা মনে করেন, কবিতা মানুষের মর্মতেজ উদ্বুদ্ধ করতে পারে, রীতিনীতি মানুষের আচরণ নিয়মমাফিক করতে পারে, আর একটি দেশের শ্রুতিমধুর সঙ্গীত হলো দেশের সমৃদ্ধির নিদর্শন। তাই দেশের উত্থান-পতন বিবেচনা করতে হলে তার সঙ্গীতের উন্নয়নের মানের বিশ্লেষণ থেকে শুরু করা যায়। ১৯৭৮ সালে মধ্যচীনের সুইচৌ শহরের একটি প্রাচীন সমাধির ভূগর্ভ থেকে বিরাট আকারের ধারাবাহিক ব্রোঞ্জঘণ্টা আবিষ্কৃত হয় । এই আবিষ্কার এক বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয়, কারণ এতে বাস্তব বস্তু দিয়ে ইতিহাসের নথিপত্রে লিপিবদ্ধ তথ্য সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। নতুন যুগের লোকেরা এর মাধ্যমে চীনের প্রাচীন সমাজের সভ্যতা, বিশেষ করে সঙ্গীত সম্পর্কে জানতে পারবেন ।
১৯৭৮ সালের জানুয়ারীতে হুপেই প্রদেশের সুইচৌ শহরের উপকণ্ঠে লেইকুতুন নামক এক জায়গার একটি প্রকল্প-নির্মাণস্থলে মাটি খননের সময়ে হঠাত্ দেখা গেল অন্য রঙের মাটি, যা এই জায়গার সাধারণ মাটি থেকে ভিন্ন। মনে হয়, প্রাচীনকালে এখানে লোকেরা একটা কিছু করেছে বা পুতে রেখেছে । এই অবস্থা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । খনন করার পর সত্যই একটি প্রাচীন কবর দেখা দিয়েছে লোকদের সামনে । কবরের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২১ মিটার লম্বা, দক্ষিণ থেকে উত্তরে ১৬ মিটার চওড়া। কবর-কক্ষ খুলে দেয়া হলে, দেখা গেল, বিরাট কফিনের ওপরে চাপা দেয়া হয়েছে ৪৭টি অতি বিরাট পাথরখণ্ড, কর্মীরা ক্রেন দিয়ে বিরাট পাথরগুলো সরিয়ে দেয়ার পর যা দেখা গেল তা পাতালপুরির মণিরত্ন নয়, বরং অনেক পানি জমে রয়েছে । পানি তিন মিটার গভীর। পানির ওপরে ভেসে আছে ভাঙ্গাকফিনের তক্তার টুকরা । প্রত্নতত্ত্ববিদরা পাম্প দিয়ে পানি নিষ্কাশন করার সঙ্গে সঙ্গে ঘোলা পানিতে থাকা কফিন পরিষ্কার করতে লাগলেন । পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়কর পুরাকীর্তির অমুল্য বস্তুগুলো দেখা দিলো। এই সমাধির ভূগর্ভ থেকে মোট ১৫ হাজার পুরাকীর্তির বস্তু আবিষ্কৃত হলো, জিনিসগুলো আট প্রকারে বিভক্ত করা যায় : ব্রোঞ্জপাত্র, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্র, গাড়ি ও ঘোড়ার সাজসরঞ্জাম, সোনার জিনিস, জেড পাথরের জিনিসপত্র, ল্যাকার(বার্নিশ)করা আসবাবপত্র, বাঁশের জিনিস ইত্যাদি। অনেক জিনিসপত্রের আকৃতি আর শৈলী খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, ভাস্কর্য বা ধাতুনির্মিত নানা প্রাণী বা মানুষের মূর্তি দেখতে সত্যিকারের মতো, ফুলের মতো নকশা খুব সুন্দর এবং অনেক জিনিস শৌখিন বা বিলাসী ধরনের। এগুলোর মধ্যে সব চেয়ে লক্ষণীয় হলো ৬৫টি ব্রোঞ্জের ঘণ্টা, এটি একটি ধারাবাহিক সেট ।
এই সেট শুধু প্রাচীন কালের অভূতপূর্ব বৃহত্তম বাদ্যযন্ত্র ব্যবস্থা নয়, উপরন্তু ব্রোঞ্জের ঢালাই শিল্পকলার মানও খুবই উন্নত। এই পূর্ণাঙ্গ বাদ্যযন্ত্র-সেট যেমন পূর্ণাঙ্গ তেমনই প্রকাণ্ডও বলা যায়। আকার আর সারেগামা অর্থাত্ স্বরলিপির মাত্রাবিন্যাস অনুযায়ী ব্রোঞ্জ-ঘণ্টাগুলোকে মোট ৮ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। সবচেয়ে বড় ঘণ্টা ১.৫৩৪ মিটার উঁচু, সবচেয়ে ছোট ঘণ্টা ০.২০৪ মিটার উঁচু। ব্রোঞ্জ- ঘণ্টাগুলোর মোট ওজন ২৫০০ কিলোগ্রাম। ঘণ্টাগুলো ব্রোঞ্জ আর কাঠ দিয়ে তৈরী তিন-স্তরবিশিষ্ট তাকে রাখা হয়। প্রতিটি ঘণ্টায় খোদিত আছে প্রাচীন চীনা ভাষার লিপি । মোট দু হাজার চার শোরও বেশি চীনা চিত্রাক্ষর খোদিত আছে। বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর দেখা গেছে, প্রত্যেক ঘণ্টা বাজালে দু রকম সুরলহরি বেরিয়ে আসতে পারে। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এই ঘণ্টার সুরলহরি খুবই সঠিক এবং শ্রুতিমধুর। এই ধারাবাহিক ঘণ্টা-সেট দিয়ে নানা রকম সংগীতের সূর বাজানো যায়।
তদন্ত চালানোর পর প্রত্নতত্ত্ববিদরাধার্য করেছেন যে, এই প্রাচীন কবরটি ছিল ‘যুদ্ধমান রাষ্ট্রসমূহের যুগে’ জেং রাজ্যের “ঈ” নামক রাজার কবর । কবরের কিছু জিনিসপত্রে খোদিত লিপি এবং “কার্বোন-১৪ ডেইটিং” পদ্ধতি অনুযায়ী প্রমাণিত হয়েছে , জেং রাজ্যের রাজা “ঈ”কে সমাধিস্থ করার সময়টি ছিল খৃষ্টপূর্ব ৪০০ সালের দিকে। জেং রাজ্যের রাজা “ঈ”কে সংক্ষেপে জেং হৌঈ বলা যায় ।
জেং হৌঈর কবর ভূগর্ভের জলস্তরের নিচে ছিল, দু হাজার বছরের বেশি দীর্ঘ সময়ে কবর বরাবরই পানিতে ডুবে ছিল , এবং এই কারণেই কবরের জিনিসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি এবং পানি বেশি থাকার ফলে চোররা কবরের ভেতরে ঢুকতে পারে নি এবং ভেতর থেকে মণিরত্ন আর ঘণ্টাগুলো চুরি করতে পারে নি।
জেং হৌইর কবর খননকাজ সমাপ্ত হওয়ার পর স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে একটি বিশেষ যাদুঘর নির্মাণ করা হয়, এবং তাতে কবর থেকে আবিষ্কৃত যাবতীয় পুরাকীর্তির নিদর্শণগুলো সংরক্ষিত রাখা এবং প্রদর্শিত করা হয় । জেং হৌঈর কবর পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং “ধারাবাহিক ঘণ্টা সেটের প্যাভিলিয়ন” প্রতিষ্ঠিত হয় । তা’ছাড়া বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্রোঞ্জঘণ্টাগুলো বাজানোর একটি প্রাচীন সঙ্গীত বাদ্যযন্ত্রীদল গঠিত হয়েছে, যাতে বর্তমান কালের লোকেরাও এই যন্ত্রে বাজানো প্রাচীন সঙ্গীতের শ্রুতিমধুর সুর উপভোগ করতে পারেন।
|