মাইচি পাহাড়ের গুহা উত্তরপশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশের থিয়েনশুই নামক স্থানের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বের পাহাড়ে অবস্থিত, তার উচ্চতা দেড় শো মিটারের বেশী। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী মাইচি পাহাড়ের গুহা খোদাই করার কাজ খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে শুরু হয়, তার পর ধাপে ধাপে ৩০ মিটার আর ৭০ মিটার উঁচু দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার বৌদ্ধমূর্তি খোদাই করা হয়।
(চিত্র: মাইচি পাহাড়ের গুহার বহির্দৃশ্য)
(চিত্র:মাইচি পাহাড়ের ১২৭ নম্বর গুহার পিছন দিকে খোদিত বুদ্ধ আর অপ্সরীর মূর্তি )
বৌদ্ধমূর্তির এই সব গুহা স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। দৃশ্যটি খুবই মহিমাময় । মাইচি পাহাড়ে সংরক্ষিত রয়েছে উত্তর-ওয়েই রাজবংশ এবং পশ্চিম ওয়েই, উত্তরচৌ, সুই , থাং রাজবংশ, পাঁচ রাজবংশ, সোং,ইউয়ান , মিং , এবং ছিং রাজবংশের আমলে খোদিত ১৯৪টি গুহা এবং ৭ হাজারেরও বেশী মূর্তি( পাথর আর মাটির মূর্তি), সেগুলো দেখতে প্রাণবন্ত। তাদের মধ্যে আছে যেমন ভাবগম্ভীর বুদ্ধমূর্তি, তেমনি বোধিসত্ত্বা এবং তাদের শিষ্যদের মূর্তি। কেউ বৌদ্ধসূত্র পাঠ করছে , কেউবা কানাকানি বা ফিস ফিস করে কথা বলছে বা টিপ্পনি কাটছে, কারো কারো মুখে হাসি ফুটছে, কেউবা হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। তাছাড়া , আরও আছে বিশ্বস্ত কিশোর এবং স্ফুর্তিবাজ শিশু। একটি অমিতাভের মূর্তি ১৬ মিটার উঁচু, ছোট ভাস্কর্য মাত্র ১০ সেণ্টিমিটারের মতো উঁচু , তবে কাজ খুব সূক্ষ্ম এবং দেখতে জীবিত মানুষের মতো। মানব-সদৃশ দেবতার ভাস্কর্যগুলোতে মানুষের জীবন ফুটিয়ে তোলা হয়, দেখলে খুব মায়া লাগে । এই সব ভাস্কর্য শিল্পকর্ম চীনের বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, চীন ও বিশ্বের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব এবং লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষণার জন্য খুবই তাত্পর্যপূর্ণ । মাইচি পাহাড়ের গুহাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের গহীণ বনে অবস্থিত বলে ইতিহাসের বিভিন্ন আমলের যুদ্ধবিগ্রহে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি ,এমন-কি চুরি-ডাকাতির কবল থেকেও বেঁচে গেছে। গুহাগুলোর মূর্তি ইত্যাদি পুরাকীর্তি খুব চমত্কারভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।
মধ্যচীনের সমতলভূমি এলাকার হোনান প্রদেশের লোংমেন গুহা প্রদেশটির লোইয়াং শহরের মাত্র ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত । এখানে ইহো নদীর দু-পারে প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়নাভিরাম, মন্দিরের সারি সারি দালান দৃশ্যমান । বিভিন্ন যুগের কবি এবং পর্যটক এই দর্শনীয় স্থান খুব পছন্দ করেন । এখানে একবার এলেই আর চলে যেতে চাইছেন না। লোংমেন গুহার খোদাই কাজ শুরু হয় উত্তর ওয়েই রাজবংশের সিয়াওওয়েন সম্রাটের রাজধানী লোইয়াং শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার ( ৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দ) কাছাকাছী সময় থেকে। মোট চার শো বছরেরও বেশি সময় ধরে খোদাই আর নির্মাণ কাজ চলেছে , ফলে পাহাড়ের ভেতরে মৌচাকের মতো অনেক বেশী গুহা খোদাই করা হয়েছে । গুহার মোট সংখ্যা দু হাজার তিন শোরও বেশি । এতে মোট এক লক্ষেরও বেশি বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা হয়েছে । এখানে শিলালিপির ফলক ৩ হাজার ৬ শোরও বেশী এবং বৌদ্ধ প্যাগোডা ৪০টিরও বেশী তৈরী হয়েছে। গুহার ভেতরে সংরক্ষিত দেয়ালচিত্রে দেবী বা অপ্সরীরা পাখির মতো স্বাছন্দ্যে আকাশের মেঘরাশিতে উড়ছে , হাতে ফলমূল ধরে ঘুর্ণি পাকিয়ে নেচে নেচে উড়ছে, গান পরিবেশন করছে অথবা বৃষ্টির মতো ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের ভঙ্গিমা ভারী সুন্দর, হাবভাব সুমার্জিত।এমন শিল্পের উত্কর্ষে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।
এই সব প্রাচীন মহান শিল্পীর সৃষ্ট বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্ম এখন চীনের প্রাচীন ইতিহাস আর শিল্পকলা
গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে পরিণত হয়েছে । লোংমেন প্রস্তর-গুহাসমূহের মধ্যে একটির নাম কুইয়াং গুহা,যা উত্তর-ওয়েই রাজবংশের সিয়াও ওয়েন সম্রাটের রাজধানী লোইয়াংয়ে স্থানান্তরিত হওয়ার কাছাকাছি সময়ে( ৪৯৪ খ্রীষ্টাব্দে) খোদাই করে তৈরী হয়। লোংমেন গুহাসমূহের মধ্যে এটা অন্যতম সবচেয়ে প্রাচীন আর বিষয়বস্তুতে সমৃদ্ধ ভাস্কর্যশিল্পের গুহা । এই গুহার ভেতরে বুদ্ধমুর্তির শিল্পকর্ম খুবই সুক্ষ্ম , সুন্দর এবং বৈচিত্র্যময় । ধর্ম-প্রাণ ব্যক্তিত্বের মূর্তিগুলো ভাবগম্ভীর এবং প্রাণবন্ততা ও জীবন্ময়তার প্রতীক। এটি উত্তর ওয়েই রাজবংশ সময়পর্বের গুহার প্রস্তর-ভাস্কর্য শিল্পকর্ম গবেষণার মূল্যবান তথ্য । গুহার ভেতরকার মূর্তিগুলোর সঙ্গে সংলগ্ন শিলালিপির লিপিকলার সরল প্রাচীন শৈলী, এটি হলো চীনের লিপিকলার ইতিহাস গবেষণার মূল্যবান তথ্য । আর একটি গুহার নাম বিনইয়াং গুহা ,যা ৫০০ থেকে ৫২৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ২৪ বছর ধরে নির্মিত হয়। প্রধান বুদ্ধমূর্তি--শাক্যমুনির মূর্তি এবং তাঁর শিষ্যগণ আর বোধিসত্ত্বাদের মূর্তির মুখ এবং শরীর পাতলা, পোষাকের ঘন ঘন ভাজগুলোও সুস্পষ্ট ও সুবিন্যস্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তাতে উত্তর ওয়েই রাজবংশ আমলের ভাস্কর্যশিল্পের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়।
|