দু’হাজার বছরের বেশী সময় আগে চীনের চালু করা প্রাচীন বাণিজ্য পথ --“সিল্ক রোড” বিশ্ব-বিখ্যাত। এই পথ চীন এবং ইউরোপ,এশিয়া আর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে পাচ্য আর পাশ্চাত্যের বস্তুগত আদানপ্রদান এবং সভ্যতার বিনিময়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ।
“সিল্ক রোড” হলো প্রাচীনকালে চীন থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া তথা ইউরোপে আর উত্তর আফ্রিকায় যাওয়ার একটি বাণিজ্যের স্থল পথ। এই পথে প্রচুর পরিমাণে চীনের রেশম আর রেশমী কাপড় পশ্চিম অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিলো বলে এই পথ “ সিল্ক রোড” নামে সুপরিচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, “সিল্ক রোড” খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে চীনের হান রাজবংশের আমলে মোটামুটি গড়ে উঠে । তখনকার “সিল্ক রোড” বেয়ে আজকার আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, ইরান পর্যন্ত যাওয়া যায়। সবচেয়ে দূরে মিসরের আলেক্জাণ্ড্রিয়া শহর পর্যন্ত যাওয়া যায় । অন্য একটি পথ দিয়ে পাকিস্তানের উত্তরাংশ হয়ে আফগানিস্তানের কাবুল এবং পারস্য উপসাগরে যাওয়া যায়। কাবুল থেকে দক্ষিণ দিকে গেলে বর্তমান পাকিস্তানের করাচিতে যাওয়া যায়। সেখান থেকে নৌপথে আবার পারস্য এবং রোম সাম্রাজ্য ইত্যাদি জায়গায় যাওয়া যায়।
খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত “সিল্ক রোডে” বরাবরই পশ্চিম থেকে পূর্বে বিদ্যমান ছিল চারটি বিরাট সাম্রাজ্য। তা হলো ইউরোপের রোম, পশ্চিম এশিয়ার পারস্য(প্রাচীন ইরান), মধ্য এশিয়ার কুশান( যার ভূভাগ মধ্য এশিয়া আর উত্তরভারত জুড়ে বিস্তৃত) এবং পূর্ব এশিয়ার চীনের হান রাজবংশ । “সিল্ক রোডের” প্রচলন এই সব প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে পত্যক্ষ আদানপ্রদান আর পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয়েছে । তার পর থেকে বিশ্বের কোনো সভ্যতার উন্নয়ন আর আগের মতো আপেক্ষিক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চলছে না ।
“সিল্ক রোডের ” জটিল জাল-আকারের পথ-ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মধ্যে আদানপ্রদান ঘন ঘন চলেছে । চীনের প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ ছিল, বেশ কিছু শব্দের মধ্য চৈনিক চিত্রাক্ষর “হু” যুক্ত আছে । বিশেষ করে উদ্ভিদের নাম , যেমন হুথাও অর্থাত্ আখরোট, হুকুয়া অর্থাত্ পশ্চিমাঞ্চলের তরমুজ ইত্যাদি ফল। হুচিয়াও অর্থাত্ পশ্চিমাঞ্চলের গোলমরিচ। হুলোপো অর্থাত্ পশ্চিমাঞ্চলের মূলা( আসলে গাঁজর অর্থ বোঝায়)। এই সব জিনিস( উদ্ভিদ) প্রধানত পশ্চিম দেশগুলো থেকে আসতো । খৃষ্টীয় সপ্তম থেকে নবম শতকের থাং রাজবংশ আমলে “সিল্ক রোড” সবচেয়ে সমৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করে। তখন চীন আর পশ্চিম দিকের দেশগুলোর মধ্যে যে নানাভাবে আদানপ্রদান চলেছে , তার বৈচিত্র্যময় দৃশ্য চোখ ঝলসানোর মতো। পশ্চিম দেশগুলোর বিশেষ এবং বিরল পশুপাখি, মণিরত্ন, সুগণ্ধী দ্রব্য,কাঁচের পাত্র,সোনা ও রূপার মুদ্রা, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গীত, নৃত্য, রান্না,পোষাকপরিচ্ছদ ইত্যাদি অবিরাম ধারায় চীনে প্রবেশ করেছে । এর সঙ্গে সঙ্গে চীনের পণ্যদ্রব্য এবং প্রযুক্তিও “সিল্ক রোডের” মাধ্যমে অন্যান্য দেশে বিস্তার লাভ করেছে । যেমন , রেশমী কাপড়, কৃষিপ্রযুক্তি, তুতগাছ ও গুটিপোকা চাষ, কাগজ তৈরি এবং বই ছাপার প্রযুক্তি, ল্যাকার-জাত আসবাবপত্র, বারুদ, কম্পাস ইত্যাদি বিশ্ব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ।
পণ্যদ্রব্যের ব্যবসা চলার সঙ্গে সঙ্গে , “সিল্ক রোডের” মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও খুবই সক্রীয় ছিল । বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম ধর্মের অন্যতম ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধধর্ম হান রাজবংশের (খৃষ্টপূর্ব ২০৬-খৃষ্টীয় ২২০ খৃষ্টাব্দ) আমলে চীনে প্রবেশ করে । খৃষ্টীয় তৃতীয় শতকে চীনের সিনচিয়াং অঞ্চলের কজির গুহামন্দিরে অজস্র দেওয়ালচিত্র আঁকা হয়, এখনও প্রায় দশ হাজার বর্গমিটার দেওয়ালচিত্র সংরক্ষিত রয়েছে । এতে প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে চীনে প্রবেশের গতিপথ প্রতিফলিত হয় । অনুমাণ অনুযায়ী, বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে “ সিল্ক রোডের” মধ্য দিয়ে সিনচিয়াং অঞ্চলে প্রবেশ করে, তার পর সেখান থেকে কানসু প্রদেশের তুনহুয়াং নামক স্থান তথা চীনের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করে । “সিল্ক রোড” বরাবর এলাকায় বৌদ্ধধর্মের অনেক গুহা আজ পর্যন্ত টিকে আছে, যেমন বিখ্যাত তুনহুয়াং-এর মোকাও গুহা, মধ্যচীনের লুওইয়াং শহরের লোংমেন গুহা ইত্যাদি । এই সব গুহায় সংরক্ষিত বেশির ভাগ পুরাকীর্তি নিদর্শনের শৈল্পিক শৈলীতে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বৈশিষ্ট্য মিশে গেছে । এটাই চীন আর পাশ্চাত্যের(চীনের পশ্চিম দিকের দেশগুলোর) সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সাক্ষ্য। আজ এগুলোর সবই বিশ্ব-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।
খৃষ্টীয় নবম শতাব্দির পর ইউরোপ-এশিয়া মহাদেশের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে , বিশেষ করে নৌপরিবহন প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বাণিজ্য ক্ষেত্রে সামুদ্রিক পরিবহন ক্রমেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে শুরু করে, ফলে এই স্থল পথের “সিল্ক রোডের” ক্রমেই অবনতি ঘটে । দশম শতাব্দীতে চীনের সোং রাজবংশের আমলে “সিল্ক রোড” বাণিজ্যের মাল পরিবহণের পথ হিসেবে আর তেমন ব্যবহার করা হয় নি।
“সিল্ক রোড” হলো একটি দীর্ঘ আর প্রাচীন পথ, যা বিশ্বের সভ্যতার বিকাশের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউনেস্কোর উদ্যোগে “ সিল্ক রোড গবেষণার নতুন কার্যক্রম” শুরু হয়েছে , তাতে “সিল্ক রোডকে” “সংলাপের পথ” বলে ধার্য করা হয়, যাতে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মধ্যে সংলাপ আর আদানপ্রদান ত্বরান্বিত করা যায়।
|