রাজনৈতিক ব্যবস্থা



  গণ প্রজাতন্ত্রী চীন হলো শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত এবং শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত জন-গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মৌলিক ব্যবস্থা ।

  সংবিধান

  সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এক মৌলিক আইন । এতে সাধারণতঃ একটি দেশের সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মৌলিক নীতিসমুহ , রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সংগঠন ও তার কার্যকলাপের মৌলিক নীতিসমুহ , নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় । কোনো কোনো দেশের সংবিধানে দেশের জাতীয় পতাকা , জাতীয় সংগীত , রাজধানী আর শাসক শ্রেনীর ধারনায় গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । সংবিধান রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন দিকের সংগে সম্পর্কিত । সংবিধান সর্বোচ্চ আইনগত ক্ষমতা সম্পন্ন একটি আইনবিধি , সংবিধান অন্য আইন প্রনয়নের ভিত্তি, কোনো আইনই সংবিধানের সংগে অসংগতিপূর্ণ হতে পারে না ।

  গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে প্রকাশিত “ চীনের গণ রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের অভিন্ন কর্মসূচী ” যেমন চীনের জন- গণতান্ত্রিক ঐক্য ফ্রন্টের কর্মসূচী , তেমনি চীনের একটি অস্থায়ী সংবিধান । চীনের জনগনের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে “ অভিন্ন কর্মসূচী ” গৃহিত হওয়ার পর ১৯৪৯ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় । ১৯৫৪ সালে “ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধান ”প্রকাশের আগে “ সাধারণ কর্মসূচী ” বাস্তব ক্ষেত্রে অস্থায়ী সংবিধানের ভুমিকা পালন করেছে ।

  ১৯৪৯ সালের পয়লা অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর চীন ১৯৫৪ সালে , ১৯৭৫ সালে , ১৯৭৮ সালে আর ১৯৮২ সালে মোট চারবার সংবিধান সংশোধন ও প্রকাশ করেছে ।

  চীনের চতুর্থ সংশোধিত সংবিধান ১৯৮২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর চীনের পঞ্চম জাতীয় গণ কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে গৃহিত হয়ে প্রকাশিত হয় । এই সংবিধানে ১৯৫৪ সালের সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর উত্তরাধিকার সুত্রে বিকাশ করা হয়েছে , চীনের সমাজতান্ত্রিক বিকাশের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলো গ্রহণ করা হয়েছে । এই সংবিধান চীনের স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়নের গঠনকাজের চাহিদার সংগে সংগতিপূর্ণ একটি মৌলিক বিধান । এই বিধানে চীন গণ প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা , অর্থনৈতিক ব্যবস্থা , নাগরিকের অধিকার ও দায়িত্ব , রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিন্যাস ও তাদের দায়িত্ব আর দেশের ভবিষ্যত মৌলিক কর্তব্য স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে চীনের মৌলিক ব্যবস্থা ও মৌলিক কর্তব্য নির্ধারন করা হয়েছে এবং চারটে মৌলিক নীতি আর সংস্কার ও উন্মুক্ততার মৌলিক কর্মসুচী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । এতে বলা হয়েছে চীনের সকল জাতির জনগণ ও সকল সংগঠনের উচিত সংবিধানের মৌলিক নীতি অনুসরণ করা , কোনো সংগঠন বা ব্যক্তির সংবিধান ও আইন অতিক্রম করার বিশেষ অধিকার নেই ।

 এই সংবিধান পাঁচ ভাগে বিভক্ত , এই পাঁচ ভাগ হলোঃ ভুমিকা , সাধারণ নীতিসমুহ , নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব , রাষ্ট্রীয় কাঠামো , জাতীয় পতাকা ও জাতীয় প্রতীক আর রাজধানী । সংবিধানে মোট চার অধ্যায়ে ১৩৮টি ধারা আছে । সংবিধানটি প্রকাশের পর আরো নিখুঁত করার জন্য মোট চার বার সংশোধন করা হয়েছে।

  গণ কংগ্রেস ব্যবস্থা

   গণ কংগ্রসব্যবস্থা চীনের এক মৌলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা । এই ব্যবস্থা চীনের জন-গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের সাংগঠনিক রুপ এবং চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা । গন কংগ্রেস ব্যবস্থা পাশ্চাত্য দেশগুলোর মত তিন ক্ষমতা পৃথকীকরন ব্যবস্থার সংসদ নয় , চীনের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় গণ কংগ্রেস চীনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ সংস্থা। চীনা নাগরিকের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয় , তাদের গণ কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচন ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার আছে । চীনে বিভিন্ন স্তরের গণ কংগ্রেসের মধ্যে জেলা ও মহকুমা স্তরের গণ কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন । জেলার উর্ধতন স্তরগুলোর গণ কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন । জাতীয় গণ কংগ্রেস চীনের বিভিন্ন প্রদেশ , স্বায়তশাসিত অঞ্চল, কেন্দ্রশাসিত মহানগর আর সৈন্যবাহিনীর নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত , বিভিন্ন স্তরের গণ কংগ্রেসের কার্যমেয়াদ পাঁচ বছর , প্রতি বছর গণ কংগ্রেসের একবার পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ।

  প্রতিবছর গণ কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে গণ কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা সরকারের কাজকর্ম সংক্রান্ত রিপোর্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট শুনেন , এই সব রিপোর্ট পর্যালোচনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব গ্রহন করেন । বার্ষিক সম্মেলন সমাপ্ত হওয়ার পর বিভিন্ন স্তরের গণ কংগ্রেসের স্থায়ী সংস্থা-- গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের অর্পিত দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে । যেমন জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির দায়িত্ব ও অধিকারের মধ্যে আছে সংবিধান ব্যাখ্যা করা , সংবিধানের কার্যকরীকরণ তত্ত্বাবধান করা , জাতীয় গণ কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রনয়ন করা আইনগুলো ছাড়া অন্যান্য আইনবিধি প্রনয়ন ও সংশোধন করা আর জাতীয় গণ কংগ্রেসের অর্পিত দায়িত্ব পালন করা আর তার কাছে কার্যবিবরণ দাখিল করা ইত্যাদি ।

  চীনের গণ কংগ্রেসের মূল দায়িত্ব ও অধিকারের মধ্যে আছে আইন প্রনয়নের অধিকার , তত্ত্বাবধানের অধিকার , গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আর পদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারনের অধিকার ইত্যাদি । চীনে নির্দিষ্ট সময়পর্বের জাতীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রনয়ন করা চীনের সামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত করার এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য , তবে জাতীয় গণ-কংগ্রেসের অনুমোদন পাওয়ার পরই শুধু এই পরিকল্পনা আইনগতভাবে বৈধতা পাবে । চীনের আইনে বলা হয়েছে , চীনের প্রেসিডেন্ট , জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান প্রমুখ দেশের প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দ জাতীয় গণ কংগ্রেসের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন । জাতীয় গণ কংগ্রেস রাষ্ট্রীয় পরিষদের প্রধানমন্ত্রীও মন্ত্রীবর্গ মনোনয়নের দায়িত্ব পালন করে । জাতীয় গণ কংগ্রেস নির্বাচিত জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান , প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রীয় পরিষদের প্রধানমন্ত্রী অপসারনের প্রস্তাব দাখিল করতে পারে ।

  বহু দলীয় সহযোগিতা ও রাজনৈতিক পরামর্শ ব্যবস্থা  

  চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বহুদলীয় সহযোগিতা ও রাজনৈতিক পরামর্শ ব্যবস্থা চীনের একটি মৌলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ।  
  চীনে একাধিক রাজনৈতিক দল আছে । ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি ছাড়া আরো আটটি গণতান্ত্রিক দল আছে । এই সব গণতান্ত্রিক দল গণ প্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , কমিউনিষ্ট পার্টির সংগে দীর্ঘদিন সহযোগিতা করা আর মিলিতভাবে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্ব সমর্থন করার অধিষ্ঠান বেছে নিয়েছে । চীনের কমিউনিষ্ট পার্টি ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলকে সংবিধানকে তাদের মূল কর্মসুচী হিসেবে মেনে নিতে হবে । সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল স্বাধীন । তারা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন এবং সমান আইনগত অবস্থান পায়। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সংগে চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির সহযোগিতার মৌলিক নীতি হলো দীর্ঘদিন সহাবস্থান করা , পরস্পরকে তত্ত্বাবধান ও বিশ্বাস করা আর সুখ - দুঃখের সমভাগী হওয়া ।  

  চীনের গনতান্ত্রিক দলগুলো ক্ষমতাচ্যুত বা বিরোধী পার্টি নয় , তারা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অংশ নেয় , তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অংশ নেয়ার মৌলিক বিষয় হলো দেশের মূল নীতি ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের মনোনয়ন সংক্রান্ত পরামর্শে অংশ নেয়া , রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের পরিচালনায় অংশ নেয়া আর রাষ্ট্রীয় নীতি , আইন ও আইনবিধির কার্যকরীকরনে অংশ নেয়া ।

  দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নেয়া অথবা জনগনের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত সমস্যা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে চীনের কমিউনিষ্ট পার্টি গণতান্ত্রিক দল ও নির্দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যক্তির সংগে পরামর্শ করে এবং তাদের মতামত ও প্রস্তাব পর্যালোচনা করার পর সিদ্ধান্ত নেয় । গণতান্ত্রিক দলগুলো আর নির্দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অংশ নেয়ার ও তত্ত্বাবধানের ভুমিকা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্টীয় ক্ষমতা সংস্থা-- জাতীয় গণ কংগ্রেস ও তার স্ট্যান্ডিং কমিটি , বিশেষ কমিটির স্থায়ী সংস্থায় আর বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় গণ কংগ্রেসে নির্দিষ্ট অনুপাতের গণতান্ত্রিক দল ও নির্দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যক্তি আছেন । গণ রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক দল ও নির্দলীয় গনতান্ত্রিক ব্যক্তিদের ভুমিকা আরো জোরদার করা উচিত , গণতান্ত্রিক দল ও নির্দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যক্তিদের সরকার ও আইন সংস্থার নেতৃস্থানীয় পদে নিয়োগ করার পরামর্শ দেয়া উচিত ।

  বহু দলের সহযোগিতা ও রাজনৈতিক পরামর্শের রুপ প্রধানতঃ পাঁচিট , এক , গণ রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন। গণ রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল , বিভিন্ন গণ গোষ্ঠী আর বিভিন্ন মহলের প্রতিনিধিদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপার পর্যালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান । দুই , চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিভিন্ন স্তরের পার্টি কমিটির উদ্যোগে গণতান্ত্রিক দল ও নির্দলীয় ব্যক্তির আলোচনা সভার আয়োজন করা , এতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তাদের জানানো হয় , দেশের প্রধান প্রধান নীতি , জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নেতৃবৃন্দের পদপ্রার্থীদের নামের তালিকা , গণ কংগ্রেস ও রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্যদের প্রার্থীদের নামের তালিকা নিয়ে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সংগে মতবিনিময় করা এবং তাদের মতামত ও প্রস্তাব শ্রবণ করা । তিন , গণতান্ত্রিক দলগুলোর গণকংগ্রেস প্রতিনিধিদের গণ কংগ্রেস প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন স্তরের গণ কংগ্রেসে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অংশ নেয়া আর তত্ত্বাবধানের ভূমিকা নেয়া । চতুর্থ , গণতান্ত্রিক দলগুলোর যোগ্য ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় পরিষদ , বিভিন্ন মন্ত্রনালয় , জেলা পর্যায় ও তার উর্ধতন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার আর সংশ্লিষ্ট বিভাগের নেতৃস্থানীয় পদে অধিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করা । পাঁচ , গণতান্ত্রিক দলগুলোর উপযুক্ত ব্যক্তিকে অভিশংসক ও বিচার বিভাগের নেতৃস্থানীয় পদে অধিষ্ঠিত করার সুপারিশ করা ।