খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দি থেকে খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দি পর্যন্ত ছিল চীনের বসন্ত আর শরত যুগ । তখন কয়েকটি শক্তিশালী রাজ্য পাশাপাশি ছিল । তার মধ্যে একটির নাম ছিল চিন রাজ্য । চিন রাজ্যে দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন । একজন ছিলেন সাংস্কৃতিক মন্ত্রী চাও তুন। তিনি রাজদরবারের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন । অন্য একজন ছিলেন সেনাপতি থু আনকু । চাও তুনের সংগে তার মনোমালিন্য ছিল এবং তিনি মনেপ্রাণে চাও তুনকে নিধন করতে চাইতেন ।
চাও তুনকে হত্যা করার জন্যে থু আনকু আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন । চিন রাজ্যের রাজা তার কথা শুনে মনে করলেন , চাও তুন ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক এবং আদেশ দিয়ে চাও তুন , তার পরিবার আর চাকরদের সহ ৩ শ’রও বেশী লোককে হত্যা করলেন । কেবল চাও তুনের পুত্রবধু চুয়াং চি রাজকুমারী ছিলেন বলে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে রাজপ্রাসাদে বন্দী হয়েছিলেন ।
তখন চুয়াং চি গর্ভবতী ছিলেন । কিছু দিন পর রাজপ্রাসাদে তাঁর একটি ছেলের জন্ম হয় । তিনি “ চাও পরিবারের অনাথ” নামে পরিচিত ছিলেন । চুয়াংচি আশা করলেন , তাঁর ছেলে বড় হয়ে যাওয়ার পর চাও পরিবারের জন্যে প্রতিশোধ নেবেন । থু আন কু এই খবর জেনে রাজপ্রাসাদের দরজায় কঠোর পাহারা দেয়ার আদেশ দিলেন।
এক মাস পূর্ণ হওয়ার সময়ে তিনি এই অনাথকে হত্যা করতে চাইলেন যাতে ভবিষ্যত বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । চাও তুনের একজন বন্ধু ছেং ইং ডাক্টার ছিলেন । চাও পরিবারের এই অনাথকে বাচিয়ে তোলার জন্যে রাজকুমারীর রোগ দেখার ওজুহাতে ওষুধের বাক্স কাঁধে নিয়ে রাজপ্রাসাদে আসলেন । তিনি অনাথ শিশুকে ওষুধের বাক্সের মধ্যে বসিয়ে চুপিসারে তাঁকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন । তবে রাজপ্রাসাদের দরজায় টহলদার সেনাপতি হান চুয়ে তা উদ্ধার করলেন । হান চুয়ে চাও তুনের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন । তিনি ছেংইং আর অনাথকে ছেড়ে দিলেন এবং নিজে তলোয়ার দিয়ে আত্মহত্যা করলেন ।
এই খবর পেয়ে থু আন কু আদেশ দিলেন , ৩ দিনের মধ্যে অনাথকে ফিরিয়ে না দিলে চিন রাজ্যের ১ বছরের নীচে বয়সের সমস্ত শিশুকে মেরে ফেলা হবে ।
ছেংইং আর চাও তুনের অন্য একজন বন্ধু কুং সুন ছু চিউ এই সম্বন্ধে পরামর্শ করলেন । তারা মনে করলেন , একজন লোক একটি শিশুকে সংগে নিয়ে নিজের প্রাণের ঝুঁকি দিয়ে বন্দী হলেই কেবল চাও পরিবারের অনাথ আর চিন রাজ্যের সমস্ত শিশুকে বাঁচানো যাবে । ছেংইংয়ের নিজেরও একটি ছেলে ছিল এবং বয়স চাও পরিবারের অনাথের কাছাকাছি । ছেং ইং নিজের বেদনা দমন করে নিজের ছেলেকে তাঁর বন্ধু কুংসুনছুচিউ’র হাতে অর্পণ করলেন । তারপর তিনি মেকি করে থু আন কুর কাছে খবর দিলেন এবং বললেন , কুংসুনছুচিউ গোপনে চাও পরিবারের অনাথকে বাসায় রাখলেন । ফলে কুংসুনছুচিউ ও তাঁর কাছের সেই ছেলেকে হত্যা করা হলো।
থু আন কু মনে করলেন , চাও পরিবারের অনাথ মারা গেছে । তিনি খুবই আনন্দিত হলেন । তাঁর নিজের কোনো ছেলে ছিল না বলে ছেংইংয়ের ছেলেকে (বস্তুত সে চাও পরিবারের ছেলে ) নিজের ছেলে হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং তাকে কুং ফু শিখালেন । চিন রাজ্যের লোকেরা মনে করল, ছেংইংয়ের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে চাও পরিবারের অনাথ নিহত হয়েছে । সবাই তাকে গালিগালজ করলেন । ছেংইং নিজের পক্ষে ওকালতি না করে চাও পরিবারের অনাথকে লালন পালন করলেন ।
১৫ বছর পর চিন রাজ্যের অন্য একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি ওই চিয়াং সীমান্ত থেকে রাজধানীতে ফিরে আসার পর চাও তুনের পরিবারের দুর্যোগের কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন এবং ছেংইংকে বেদম মারধোর করলেন ।
ছেংইং কোনো কথা বললেন না । ওই চিয়াং তাকে যত প্রচন্ডভাবে মারলেন , তিনি তত নিশ্চিন্ত হলেন । কারণ তিনি মনে করলেন , এতে প্রমাণিত হয় যে , ওই চিয়াং বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রীকে খুবই ঘৃণা করেন এবং তিনি প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে চাও পরিবারের অনাথকে সাহায্য করতে পারেন । ছেং ইং ওই চিয়াংয়ের বিশ্বস্ততা পরীক্ষা করার পর নিজের ছেলের প্রাণ দিয়ে এবং তাঁর বন্ধু কুংসুনছুচিউয়ের জীবন বিসর্জন দিয়ে চাও পরিবারের অনাথকে বাঁচানোর কাহিনী ওই চিয়াংকে জানিয়ে দিলেন । এতে ওই চিয়াং অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন । তিনি চাও পরিবারের অনাথকে সহায়তার ব্যাপারে সম্মতি হলেন ।
বাড়িতে ফিরার পর ছেংইং সেই কাহিনীকে ভিত্তি করে ছবি এঁকে অনাথকে জানিয়ে দিলেন । এইভাবে অনাথ নিজের করুণ কাহিনী জানতে পারলেন এবং নিজের পরিবারের জন্যে প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নিলেন ।
|