ইয়ু অপেরার অন্য নাম “হোনান পাংচি” ও “হোনান কাওতিয়াও” । যেহেতু প্রথম সময়কার শিল্পীরল গলায় গান করেন এবং শুরু আর শেষ করার সময়ে মেকী গলায় “ও” ব্যবহার করেন , সেহেতু ইয়ু অপেরার আর একটি নাম “হোনান ও” । আগে হোনান প্রদেশের পশ্চিম অঞ্চলে হোনান পাংচি প্রায় ছোট পাহাড়কে অবলম্বন করে গড়ে উঠা মঞ্চে মঞ্চস্থ হতো । তাই লোকেরা হোনান পাংচিকে “ পাহাড়কে অবলম্বনকারী উচ্চস্বর বলে আখ্যা দিতো। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পরই “ ইয়ু অপেরার ”নাম ব্যবহার শুরু হয় । ইয়ু অপেরা চীনের হোনান , হোপেই , শানতুং , শানসি , হুপেই , নিংসিয়া , ছিংহাই , সিনচিয়াং প্রভৃতি দশ বারোটি প্রদেশ আর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে এবং চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী অপেরার অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
চীনের মিং রাজবংশের শেষ দিক আর ছিং রাজবংশের প্রথম দিকে ইয়ু অপেরার উদ্ভব ঘটে । প্রথম দিকে কোনো বাজনা ছাড়া গান করা হোতো । তখন ইয়ু অপেরা জনসাধারণের মধ্যে বেশ সমাদর পায় বলে এর দ্রুত উন্নতি হয় । ইয়ু অপেরার উত্পত্তির অনুসন্ধান খুবই মুশ্কিল এবং এই সম্বন্ধে ভিন্ন মত রয়েছে । কেউ কেউ বলে মিং রাজবংশে ছিনছিয়াং আর ফুচৌপাংচি হোনান প্রদেশে প্রচলিত হওয়ার পর স্থানীয় লোকসংগীতের সংগে এর সমন্বয়ে ইয়ু অপেরার উদ্ভব ঘটে । কেউ কেউ বলে উত্তর ছুইসুয়ানসোতিয়াও থেকে ইয়ু অপেরার সরাসরি বিকাশ হয় ।
ইয়ু অপেরার উদ্ভবের পর তার বিভিন্ন শৈল্পিক রীতিনীতি দেখা দেয়। ইয়ু অপেরা মোটামুটি ৪টি বিভাগে বিভক্ত হয় : খাইফোংয়ের সিয়াংফু তিয়াও , শাংছিওয়ের পুর্ব হোনান তিয়াও ( অন্য নাম তুংলুতিয়াও ) , লোওইয়াংয়ের পশ্চিম হোনান তিয়াও ( অন্য নাম সিফুতিয়াও অথবা খাওশানহুয়াং ) এবং লোওহোর সাহোতিয়াও ( অন্য নাম স্থানীয় পাং ) । সুর প্রধানত মানপান , আরপাপান , লিউসুই ও ফেইপানে বিভক্ত । প্রধান রীতিনীতি পূর্ব হোনান তিয়াও আর পশ্চিম হোনানতিয়াওয়ে বিভক্ত । পূর্ব হোনানতিয়াওয়ের পুরুষ কণ্ঠ উচ্চ ও উদাত্ত আর মেয়েকণ্ঠ প্রাণবন্ত ও উঠানামা ধরণের । এই রীতির অপেরা কৌতুহলী নাটক করতে নিপুণ ।
পশ্চিম হোনানতিয়াওয়ের পুরুষকণ্ঠ ম্লান ও বেদনাদায়ক আর মেয়েকণ্ঠ নীচু ও মনোরম । এই রীতির অপেরা ট্র্যাজেডি মঞ্চস্থ করতে নিপুণ ।
ইয়ু অপেরার প্রধান সহযোগী বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে পানহু, আরহু , তিনতারা , ফিফা, বাঁশি , শেং , সানাই প্রভৃতি। পাং চির তালে তালে ইয়ু অপেরা চলে । পাং চির তাল দ্রুত আর আনন্দদায়ক ।
ইয়ু অপেরার প্রাধান্য হলো তার গানগুলো । নাট্যকাহিনীর সন্ধিক্ষণে প্রায় দীর্ঘ সময়ের গানের ব্যবস্থা করা হয় । সাধারণত শিল্পীরা উদাত্তকণ্ঠে গান করেন । তাতে এই অপেরার বিশেষ নৈপুণ্য প্রকাশ পায় । ইয়ু অপেরার প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , ইয়ু অপেরার রয়েছে প্রাণবন্ত ও উদার মনোবল । এ অপেরা বিরাটায়তনের নাটক মঞ্চস্থ করতে নিপুণ । এর ভাবানুভূতির প্রবল শক্তি আছে । ইয়ু অপেরার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , এ অপেরার গভীর স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আছে এবং অপেরা সরল ও স্বাভাবিক বলে জনসাধারণের জীবনের সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। ইয়ু অপেরার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , এর স্পষ্ট আর প্রবল ছন্দ রয়েছে , তীব্রতর দ্বন্দ্ব আর সংঘর্ষ আছে , নাটকের পুরো কাহিনী রয়েছে এবং বিভিন্ন চরিত্রের স্পষ্ট স্বভাব আছে ।
১৯২৭ সালের আগে হোনান পাংচি দলগুলোতে কোনো মেয়ে শিল্পী ছিল না। পরে মেয়ে শিল্পী দেখা দেয়ার পর ধাপে ধাপ ছাং সিয়াংইয়ু, ছেন সুচেন , মা চিনফোং , ইয়ান লিফিন ও ছুই লানথিয়ান ৫জন বিখ্যাত শিল্পীর ৫টি প্রধান শৈলী গড়ে উঠে । ছাংপন্থী শিল্পীদের কণ্ঠ উদার ও প্রাণবন্ত , ছেনপন্থী শিল্পীদের কন্ঠ দ্রুত ও নতুন, মাপন্থী শিল্পীদের কন্ঠ দৃঢ় ও উজ্জ্বল, ছুইপন্থীশিল্পীদের কন্ঠ গভীর ও সারগর্ভ এবং ইয়ানপন্থীর কন্ঠ সূক্ষা ও মনোরম । বর্তমানে এই ৫টি শৈলীর শিল্পীদের শিষ্যরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে ।
ইয়ু অপেরার রয়েছে ১ হাজারেও বেশী ঐতিহ্যিক নাট্যকর্ম । এগুলোর মধ্যে অনেক নাট্যকর্ম এঐতিহাসিক উপন্যাস আর রূপকথাকে ভিত্তি করে রচিত হয় । যেমন । ফোংশেনের অপেরা . তিন রাজ্যের অপেরা , ওয়াকাংয়ের অপেরা , পাওকোংয়ের অপেরা , ইয়াং পরিবারের সেনাপতিদের অপেরা আর ইয়ুও পরিবারের সেনাপতিদের অপেরা । তাছাড়া আরো আছে বিয়ে , প্রেম আর নৈতিকতা বর্ণনা করার অপেরা । চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর বাস্তব জীবনের ভিত্তিতে রচিত আধুনিক অপেরা আর নতুন করে রচিত ঐতিহাসিক অপেরা দেখা দেয় এবং ইয়ু অপেরার নতুন বিকাশ ঘটে । এই নতুন অপেরার মধ্যে রয়েছে “ ছিয়াওইয়াংকো “ , “ ছোট আরহের বিয়ে “ , মানুষ আর ঘোড়ার আনন্দ “ , “ দুর্ভাগ্যবান চাচার বিয়ে ” , “ স্বামীর পরীক্ষা” , “ বেড়া লাল হয়ে গেছে ” ।
আজ পর্যন্তওইয়ু অপেরা ব্যাপক জনসাধাণের মধ্যে সমাদর পায় । তবে তার বিকাশের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে গুরুতর সমস্যা । দর্শকদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অপেরা দলের অস্তিত্ব কঠিন হয়ে পড়ে । শিল্পী সহ রচয়িতাদের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে । সাংস্কৃতিক আর শিল্পগত মান এবং যুগের চাহিদার মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান । ইয়ু অপেরার বৈশিষ্ট্য আর বিকাশের দিকস্থিতির ক্ষেত্রে তত্বগত আয়ত্তকরণের অভাব রয়েছে বলে উত্তরধিকার বিকাশ আর সংস্কারের অন্ধ তত্পরতা চলেছে।
|