পেইচিং অপেরার ইতিহাস


       চীনের পেইচিং অপেরা “প্রাচ্যের অপেরা” বলে অভিহিত হয় । তা পুরোপুরিই চীনা সংস্কৃতির মূল্যবান মুক্তা । পেইচিংয়ে এর জন্ম হয়েছে বলে পেইচিং অপেরা নামে পরিচিত । পেইচিং অপেরার রয়েছে দু শ’রও বেশি বছরের ইতিহাস । তার উত্পত্তি খুঁজে বের করতে হলে কয়েক ধরনের প্রাচীন স্থানীয় অপেরার কথার উল্লেখ করতে হবে , বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দিতে দহ্মিণ চীনে প্রচলিত “হুয়ে অপেরা”র কথার উল্লেখ করতে হবে । ১৭৯০ সালে সম্রাটের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অভিনয়ের জন্যে প্রথম হুয়ে অপেরার দল পেইচিংয়ে প্রবেশ করে । তারপর আরো কিছু সংখ্যক হুয়ে অপেরার দল অভিনয়ের জন্যে পেইচিংয়ে যায় । হুয়ে অপেরার দল মূলত ভ্রাম্যমান অভিনয় করে বেড়াতো এবং অন্যান্য অপেরার নাট্যকর্ম আর অভিনয় পদ্ধতি আহরণ করতে নিপুণ ছিল । যেহেতু এক সময়ে পেইচিংয়ে বহু সংখ্যক স্থানীয় অপেরার সমাগম ছিল , সেহেতু শিল্পকলার ক্ষেত্রে হুয়ে অপেরার দ্রুত উন্নতি হয়।

 

     উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিক আরবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে কয়েক দশকের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে পেইচিং অপেরার উদ্ভব ঘটে এবং চীনের সবচেয়ে বড় অপেরায় পরিণত হয় । নাট্যকর্মের সমৃদ্ধি , বড় বড় শিল্পী, অপেরা দলওঅনুরাগীদের সংখ্যাধিক্য আর প্রভাবের ব্যাপকতার দিক থেকে পেইচিং অপেরার স্থান চীনেপ্রথম। পেইচিং অপেরা হচ্ছে একটি বহুমুখী অভিনয়ের শিল্পকলা। পেইচিং অপেরা গাওয়া , আবৃত্তি , অভিনয় , লড়াই আর নাচার মিশ্রণ করে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাহিনীর বর্ণনা করে এবং চরিত্রের অভিনয় করে । পেইচিং অপেরার ভূমিকা প্রধনত চারটি বড় পেশায় বিভক্ত । সেগুলোহল শেং ( পুরুষ ) , তান ( মেয়ে ) , চিং ( পুরুষ ) আর ছৌ ( পুরুষ , মেয়ে উভয় ) । তাছাড়া আরো রয়েছে কতিপয় সহায়তাকরী পেশা । মুখের রং হচ্ছে পেইচিং অপেরার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসপন্ন শিল্পকলা । মুখের রং থেকে চরিত্রের বিশ্বস্ততাআর বিশ্বাসঘাতকতা, সৌন্দর্য্যআর কুত্সিততা, নম্রতা আর হিংস্রতা এবং মর্যদা আর হেয়তার প্রদর্শন হতে পারে । যেমন ধরা যাক , লাল মুখ চরিত্রের বিশ্বস্ততার বর্ণনা করে । বেগুণী মুখ বিজ্ঞতা,সাহসিকতা আর কঠিণতার পরিচায়ক । কালো মুখ মানুষের সরলতা , ন্যায়বিচারের মূল্যবান চরিত্রের প্রদর্শন করে। সাদা মুখ চরিত্রের জালিয়াতি আর হিংস্রতার প্রতীক হয় । নীল মুখ কঠিনতা আর নির্ভীকতার পরিচায়ক । হলুদ মুখ মানুষের নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয় । সোনালী আর রূপালী মুখ দেবতা , বুদ্ধআর দানবের ভুমিকায় ব্যবহৃত হয় এবং সোনালী মুখ আর সোনালী গা দিয়ে কাল্পনিকতার প্রতীক হয় । সাধারণত মনে করা হয় , অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিক ছিলপেইচিং অপেরার উন্নয়নের প্রথম শীর্ষ পর্যায়। তখন যেমন জনসাধারণের মধ্যে পেইচিং অপেরা ঘনঘনমঞ্চস্থ হত , তেমনি রাজপ্রাসাদের ভেতরেওপেইচিং অপেরা মঞ্চস্থ হত ঘনঘন । যেহেতু রাজপরিবারের অভিজাত্য লোকেরা সবাই পেইচিং অপেরা পছন্দ করতেন , সেহেতু রাজপরিবারের উত্কৃষ্ট বস্তুগত অবস্থা পেইচিং অপেরার অভিনয় . কাপড় পড়ার নিয়মাবলী , মুখের রংয়ের মেক আপ, মঞ্চসজ্জা প্রভৃতি ক্ষেত্রেবলিষ্ঠ সহায়তা করে । রাজপরিবার আর জনসাধারণের মধ্যে মঞ্চস্থ পেইচিং অপেরার পারস্পরিক প্রভাবের ফলে পেইচিং অপেরার অভূতপূর্ব উন্নতি হয় । গত শতাব্দির বিশ-চল্লিশের দশক ছিল পেইচিং অপেরার উন্নয়নের দ্বিতীয় শীর্ষ পর্যায়। এইসময়পর্বে পেইচিং অপেরার সমৃদ্ধির নিদর্শন ছিল নানা রীতিনীতির শীর্ষ শিল্পীরআবির্ভাব। সবচেয়ে বিখ্যাত চারটি রীতিনীতির শীর্ষ শিল্পীর নাম হলো মেই ,শাং , ছেং আর সিয়ুন। মেই হচ্ছে মেই লানফাং ( ১৮৯৪-১৯৬১ ) । শাং হচ্ছে শাং সিয়াওইয়ুন ( ১৯০০-১৯৭৫) । ছেং হচ্ছে ছেং ইয়ানছিউ ( ১৯০৪-১৯৫৮ ) । সিয়ুন হচ্ছে সিয়ুন হুয়েশেং ( ১৯০০-১৯৬৮) । প্রতিটি রীতিনীতির পেইচিং অপেরার ছিল বিপুল সংখ্যক নাম করা শিল্পী যারা শাংহাই , পেইচিং প্রভৃতি বড় বড় শহরের মঞ্চেতত্পর ছিলেন এবং পেইচিং অপেরার মঞ্চে ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মেই লানফাং ছিলেন সারা বিশ্বে চীনের সবচেয়ে পরিচিত পেইচিং অপেরার অন্যতম শিল্পী । তিনি ৮ বছর বয়সে পেইচিং অপেরা শিখতে শুরু করে এবং ১১ বছর বয়সে মঞ্চে উঠে অভিনয় করেন । পঞ্চাশাধিক বছরের অভিনয়ের ইতিহাসে মেই লানফাং “তান” ভূমিকার গাওয়া , আবৃত্তি , নাচ , সংগীত , পোষাক , মেক আপ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সৃজনশীল উন্নতি সাধন করেছেন এবং নিজের বিশেষ শিল্পশৈলী গড়ে তুলেছেন । ১৯১৯ সালে মেই লান ফাং চীনের পেইচিং অপেরা দল নিয়ে জাপানে গিয়ে অভিনয় করেছিলেন । এটা ছিল বিদেশে চীনের পেইচিং অপেরার প্রথম অভিনয় । ১৯৩০ সালে মেই লানফাং আবার পেইচিং অপেরা দল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অভিনয় করেন এবং বিরাট সাফল্য অর্জন করেন । ১৯৩৪ সালে তিনি আমন্ত্রণক্রমে ইউরোপ সফর করেন এবং ইউরোপের অপেরা মহলের গুরুত্ব লাভ করেন । তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান পেইচিং অপেরাকে চীনের অভিনয়-অপেরা হিসেবে অভিহিতকরতে শুরু করেন । 

(চিত্র: চারটি সুপরিচিত শিল্পী : মেই লানফাং ,ছেং ইয়ানছিউ ,সিয়ুন হুয়েসেং আর শাং সিয়াওইয়ুন )

      চীনে সংস্কার আর উন্মুক্ততার নীতি চালু হওয়ার পর পেইচিং অপেরার নতুন বিকাশ হয়েছে । উত্কৃষ্ট ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা হিসেবে পেইচিং অপেরা চীন সরকারের কাছ থেকে বিরাট সমর্থন লাভ করেছে । আজ সারা বছর পেইচিংয়ের সুবৃহত ছাং আন থিয়েটারে বিভিন্ন পেইচিং অপেরা মঞ্চস্থহয় । প্রতি বছর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পেইচিং অপেরা অনুরাগীদের প্রতিযোগিতা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের পেইচিং অপেরা অনুরাগীদের আকর্ষণ করে । তাছাড়া পেইচিং অপেরা অন্যান্য দেশের সংগে আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেএকটি সংরক্ষিত অনুষ্ঠানও বটে ।