চীনের তিনটে ঐতিহ্যিক উত্সবের খাবার—ইউয়ান সিয়াও , চুন চি আর ইউয়ে পিং

       চীনের ঐতিহ্যিক উত্সবগুলোতে চীনা অধিবাসীরা বিশেষ ধরনের খাবার খান। বসন্ত উত্সব , তুয়ান উ উত্সব ও মধ্য শরত উত্সব চীনের তিনটে সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যিক উত্সব । ইউয়ান সিয়াও , চুন চি আর ইউয়ে পিং হচ্ছে এই তিনটি উত্সবের সময় খাওয়া জনপ্রিয় খাবার । 

  চীনের বসন্ত উত্সব হচ্ছে চীনের চান্দ্র বর্ষের নববর্ষ উত্সব এবং চীনা নাগরিকদের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যিক উত্সব । বসন্ত উত্সব উদযাপন উপলক্ষে নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহন করা হয় । চান্দ্র বর্ষের প্রথম মাসের ১৫তম দিন ইউয়েন সিয়াও খাওয়া বসন্ত উত্সব উদযাপনের শেষ কর্মসূচী । সেই দিন সমগ্র চীনের সবাই ইউয়েন সিয়াও নামে এক ধরনের মিষ্টি খাবার খান । তবে দক্ষিণ চীনের অধিবাশীরা এই ধরনের মিষ্টি খাবারকে ‘ থান ইউয়েন ’ বলেন আর উত্তর চীনের অধিবাশীরা তাকে ইউয়েন সিয়াও বলেন । উত্তর ও দক্ষিণ চীনের নাগরিকদের ইউয়েন সিয়াও তৈরীর পদ্ধতিও ভিন্ন । 

  উত্তর চীনে ইউয়েন সিয়াওয়ের মিষ্টি পুর আঠালো চাউলের গুড়া মাখিয়ে ইউয়েন সিয়াও তৈরী করা হয় । তারা প্রথমে তিল , চীনা বাদাম , বিভিন্ন ধরনের ডাল গুড়া করে চিনি মিশিয়ে ইউয়েন সিয়াওয়ের মিষ্টি পুর তৈরী করেন , তার পর এই পুরের উপর পানি ছিটিয়ে আঠালো চাউলের গুড়া রাখা পাত্রে ঢেলে দেন । তার পর পাত্রটি হাত বা যন্ত্রের সাহায্যে নাড়াচাড়ার মধ্য দিয়ে মিষ্টি পুরগুলোর উপর আঠালো চাউলের গুড়া এঁটে দেয়া হয় । পুরগুলো যখন ডিমের চেয়ে একটু ছোট গোল গোল আকারে পরিণত হয় , তখন ইউয়েন সিয়াও তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয় । অতীতে প্রতিটি পরিবারে নিজ হাতে ইউয়েন সিয়াও তৈরী করা হত , এখন নাগরিকরা আর নিজে ইউয়েন সিয়াও তৈরী করেন না , ইউয়েন সিয়াও উত্সবের সময় রাস্তার খাবার দোকানে ইউয়েন সিয়াও বিক্রি হয় । পেইচিংয়ে ‘তাও সিয়ান ছুন ’ ও ‘কুই সিয়ান ছুন ’ নামে দুটি বড় খাবারের দোকানের তৈরী ইউয়েন সিয়াও সবচেয়ে বিখ্যাত । 

  দক্ষিণ চীনের নাগরিকরা ইউয়েন সিয়াও উত্সবে নিজে থান ইউয়েন তৈরী করেন । তারা আঠালো চাউলের গুড়ার মধ্যে গরম পানি মিশিয়ে আঠালো চাউলের গুড়ার তাল তৈরী করেন । তার পর আখরোট , চীনাবাদাম , তিল ,কুল ও ডালের গুড়া দিয়ে ইউয়েন সিয়াওয়ের পুর তৈরী করেন । তার পর সেই তাল চেপ্টা করে ভিতরে পুর রেখে গোল গোল থান ইউয়েন তৈরী করেন । পূর্ব চীনের নিং পো আর পশ্চিম চীনের ছাং তু শহরের থান ইউয়েন সবচেয়ে বিখ্যাত ।  

  দক্ষিণ বা উত্তর চীনে ইউয়েন সিয়াও সিদ্ধ করার পদ্ধতি একই । ফুটন্ত পানিতে তৈরী ইউয়েন সিয়াও রেখে সিদ্ধ করা হয় । সিদ্ধ করা ইউয়েন সিয়াও নরম ও মিষ্টি , সবাই এই ধরনের মিষ্টি খাবার পছন্দ করেন । ইউয়েন সিয়াও গোল , চীনা ভাষায় গোল শব্দের উচ্চারণ হলো ইউয়েন , ইউয়ানের আরেক অর্থ হলো সম্মিলন , কাজেই ইউয়েন সিয়াও উত্সবে গোল গোল ইউয়েন সিয়াও খাওয়া পরিবার-পরিজনের কল্যান ও মহাসম্মিলনের প্রতীক ।  

  চীনের চান্দ্র বর্ষের পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিন চীনের ঐতিহ্যিক তুয়ান উ উত্সব । এই উত্সবের প্রধান অভ্যাস হলো ‘ চুন চি ’ নামক এক ধরনের খাবার খাওয়া । ‘ চুন চি ’ হচ্ছে আঠালে চাউল , নারকেলী কুল , মাংস আর বিভিন্ন ধরনের ডাল একত্রে বাঁশ পাতায় মুড়ে পুটলি করে সিদ্ধ করা এক ধরনের খাবার । চীনের বিভিন্ন জায়গায় অধিবাসীদের খাওয়ার অভ্যাস ভিন্ন বলে বিভিন্ন জায়গার ‘ চুন চির ’ উপাদান ও স্বাদ একই নয় । ‘ মাছ ও চাউলের দেশ ’ বলে পরিচিত পূর্ব চীনের সু চৌ , চিয়া সিন আর নিং পো শহরের নাগরিকদের তৈরী চুন চি দক্ষিণ চীনের চুন চির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে । দক্ষিণ চীনের চুন চিতে আঠালো চাউল ছাড়া ডাল , চেস্টনাট , কুল আর মাংস আছে । উত্তর চীনের চুন চিতে প্রধানতঃ কুল ও শুকনা ফল আছে ।  

  তুয়ান উ উত্সবে চুন চি খাওয়ার ইতিহাস সুদীর্ঘ । চীনের উপকথায় বলা হয়েছে , প্রাচীন চীনের দেশপ্রেমিক কবি ছু ইউয়েনের স্মৃতির জন্য তুয়ান উ উত্সবে চুন চি খাওয়ার অভ্যাস সৃষ্টি হয়েছে । খৃষ্টপূর্ব তিন শতাব্দীতে শত্রুরা কবি ছু ইউয়ানের দেশ ছু রাজবংশ দখল করলো , ছু ইউয়ান ক্ষোভে অভিভুত হয়ে চান্দ্র বর্ষের পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিনে নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেন । পরে অধিবাসীরা এই দিনটিকে কবি ছু ইউয়ানকে স্মরণ করার দিবস হিসেবে গণ্য করলেন । প্রতি বছরের এই দিন অধিবাসীরা বাঁশের পাত্রে আঠালো চাউল রেখে নদীতে ফেলে দেন । পরে একটি উপকথা থেকে লোকেরা জানতে পেরেছেন যে পানিতে ফেলে দেয়া চাউল নদীর ড্রাগন চুরি করে খেয়ে ফেলে । তাই অধিবাসীরা বাঁশের পাত্রের উপর গাছের পাতা ঢেকে রাখেন এবং রঙীন সুতো দিয়ে তা’ বেঁধে রাখেন । জানা গেছে , গাছের পাতা ও রঙীন সুতো দেখে ড্রাগনের ভয় লাগে । ধীরে ধীরে বাঁশের পাত্রে রাখা চাউল আজকের চুন চিতে পরিণত হয়েছে। 

  চুন চি শুধু এক ধরনের সুস্বাদু খাবার নয় , আত্মীয়সজন বা বন্ধুবান্ধবকে উপহার হিসেবেও দেয়া যায় । তুয়ান উ উত্সবে আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ীতে গেলে কিছু নিজের তৈরী চুন চি উপহার করাও চীনের এক রীতি ।  

  চীনের চান্দ্র বর্ষের অষ্টম মাসের ১৫তম দিন চীনের মধ্য-শরত উত্সব । জানা গেছে , বছরের বারো মাসে শুধু সেই চান্দ্র পূর্নিমায় আকাশের চাঁদ সবচেয়ে গোল । মধ্যশরত উত্সবের রাত্রে আকাশের গোল চাঁদ দেখার সংগে সংগে ইউয়ে পিং নামে এক ধরনের কেক খাওয়ার মধ্য দিয়ে শরত উত্সব উদযাপনের রীতি প্রচলিত আছে । ইউয়ে পিং অর্থাত মুন কেক হলো নানা রকম সুস্বাদু পুর দেয়া এক ধরনের গোল কেক । ইউয়ে পিং-এর উপরে অলীক কাহিনীর ছবি আঁকা হয়। 

  মধ্য শরত উত্সবের রাতে পরিবারের সকল সদস্য এক সাথে মিলে আকাশের চাঁদ দেখেন এবং ইউয়ে পিং ও ফলমুল খান । এই উত্সব সম্মিলনীর দিন , সেই দিন বাইরে থাকা পরিবার পরিজন বাসায় ফিরে সবার সংগে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন ।  

  চীনের বিভিন্ন জায়গায় ইউয়ে পিংয়ের স্বাদও ভিন্ন । চীনে রাজধানী পেইচিং , পূর্ব চীনের সুচৌ , দক্ষিণ চীনের কুয়াং তুং প্রদেশের ইউয়ে পিং সবচেয়ে বিখ্যাত । 

  নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সংগে সংগে ইউয়ে পিংয়ের ভিতরের পুরে চিনি , কুল , ডাল ও পদ্মফুলের বীজ ছাড়া লবনাক্ত হাঁসের ডিমের কুসুম , ফলমুল , মাখন আর কোকোও দেয়া হয় । 

   ইউয়ে পিং উত্সবের সময় আত্মীয়সজন ও বন্ধুদের বাড়ীতে যাওয়ার সময় উপহার হিসেবে দেয়া হয় , নাগরিকরা গোল গোল ইউয়ে পিং উপহার দেয়ার মাধ্যমে উত্সবের শুভেচ্ছা জানান ।