ছুসির রীতিনীতি

       চীনের চান্দ্র বর্ষের শেষ মাসের শেষ দিন হচ্ছে ছুসি । চীনা ভাষায় ছুর অর্থ বিদ্যায় করা , সির অর্থ রাত , তাই ছুসির অর্থ শেষ রাতকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো । 

  ছুসি অর্থাত বছরের শেষ দিনের নানা ধরনের রীতিনীতি আছে । সেদিন বাড়ী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস দীর্ঘদিনের । ছুসির কয়েক দিন আগে থেকেই ঘর পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয় । ছুসির দিন বাড়ী সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা ছাড়া বিছানাপত্র , লেপ তোষক ভালো করে ধুতে হয় । এই রীতি সম্বন্ধে একটি কাহিনীও আছে । প্রাচীনকালের একটি অলীক কাহিনীতে চুয়ান সু নামে এক লোকের এক অলস ছেলে ছিল , ছেলেটি কোনো কাজ করত না , সব সময় ময়লা ও ছেড়া কাপড় পরত এবং জাউ খেতো। ছুসির দিন রাত্রে এই ছেলে শীতে আর ক্ষুধায় ঘরের কোনে মৃত্যুবরণ করে । তাই ছুসির দিন চীনারা ঘরবাড়ী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার সংগে সংগে বাড়ীর ছেড়া কাপড়গুলো ফেলে দেন এবং বাসি ভাত ও তরকারী দুপুর বেলায় খেয়ে ফেলেন অথবা ফেলে দেন , চীনারা অভাব ও দারিদ্র্যের পুরনো বছরকে বিদায় করে নতুন বছরের সমৃদ্ধি কামনা করেন । 

  ঘর-বাড়ী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর চীনারা বাড়ীর দরজায় কল্যানমূলক দ্বি-চরণ শ্লোক এঁটে দেন এবং লন্ঠন ঝুলিয়ে দেন । কোনো কোনো জায়গায় ছুসির রাত্রে ‘ থু সু ’ নামে এক ধরনের পানীয় পান করেন । এই পানীয়ের মধ্যে মদ ও পানি ছাড়া নানা ধরনের ভেষজ ওষুধ মেশানো হয় । একটি উপকথায় বলা হয়েছে , প্রাচিনকালে ‘থু সু ’ নামে একটি কাচাঁ ঘরে একজন লোক থাকতেন । তিনি রোজ পাহাড়ে ভেষজ ওষুধ সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন , ছুসির সন্ধ্যায় তিনি নিজের তৈরী ভেষজ ওষুধ সিদ্ধ করে সবাইকে খাওয়ান এবং এই ওষুধের উপাদানগুলো গ্রামবাসীদের বলেন । তাই গ্রামবাসীরা তার তৈরী এই ভেষজ ওষুধকে ‘ থু সু ’ বলেন । চীনের প্রাচীন ওষুধপত্রে বলা হয়েছে ‘ থু সুর ’ মধ্যে সাত ধরনের ভেষজ ওষুধ আছে , কাজেই ‘ থু সু ’ খেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা যায় । 

  বসন্ত উত্সবের আগের দিন রাত্রে পরিবারের সবাই এক সংগে বসে বছরের শেষ খাওয়া সম্পন্ন করা চীনের প্রায় সব জায়গার ঐতিহ্যিক রীতি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা বাইরে কাজ করেন , তাঁরা যথাসম্ভব ঘরে ফিরে আসেন । সেই রাত্রে পরিবারের সকল সদস্য এক সংগে অনেক সুস্বাদু তরিতরকারী রান্না করে খান ।  

  চীন একটি বড় দেশ , তাই চীনের বিভিন্ন জায়গায় বছরের শেষ খাওয়া সম্পন্ন করার রীতিও এক নয় । দক্ষিণ চীনে বছরের শেষ খাওয়ার টেবিলে সাধারণতঃ দশ-বারোটি তরিতরকারী থাকে , এগুলোর মধ্যে মাছ ও তৌফু অর্থাত বিনকার্ড অবশ্যই থাকতে হয় । কারণ চীনা ভাষায় মাছ ও তৌফুর উচ্চারণ ও সমৃদ্ধির উচ্চারণের মিল আছে , চীনারা বছরের শেষ দিন মাছ ও তৌফু খেয়ে নতুন বছরে সুখী জীবনের প্রতি তাদের আকাঙ্খা প্রকাশ করেন । উত্তর চীনে বছরের শেষ রাতে চিয়াও চি বা মোমো খাওয়ার প্রচলন আছে । চাও চি অর্থাত ডাম্পলিং বা মোমো , মাংসের পুর দেয়া ময়দার তৈরী এক ধরনের কুলী পিঠা , সেদিন রাত্রে পরিবারের সবাই এক সংগে এই কুলী পিঠা তৈরী করেন , তার পর ফুটন্ত পানিতে পিঠাগুলো সিদ্ধ করে ভিনিগার প্রভৃতি মশলা দিয়ে খান , সবাই এক সংগে ডাম্পলিং খাওয়া পরিবারের সম্মীলনীর প্রতীক । 

  সেদিন রাতে চীনের কোনো কোনো জায়গায় বাবা-মা ছেলেমেয়ে সংগে নিয়ে আত্মীয়সজন বা বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে উপহার দেন এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান । কোনো কোনো লোক আত্মীয় বা বন্ধুকে নিজের বাড়ীতে এক সংগে বছরের শেষ খাওয়া সম্পন্ন করার দাওয়াত দেন । সেদিন রাত্রে পরিবারের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বয়োবৃদ্ধদের প্রনাম করে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয় , বয়োবৃদ্ধরা ছোটদের শ্রদ্ধা গ্রহণ করে তাদের কিছু হাতখরচ দেন , চীনে এই টাকাকে ‘ইয়া সুই ছিয়েন ’ বলা হয , মানে বছর শেষের পুরষ্কার , সাধারণতঃ বড়রা শুধু স্কুলবয়সী ছেলেমেয়েকে ‘ইয়া সুই ছিয়েন ’ দেন , যে সব ছেলেমেয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন , তাদের আর ইয়াসুই ছিয়েন অর্থাত বছর শেষের পুরষ্কার দেয়া হয় না । সেই রাত্রে সবাই নিজের ইচ্ছা অনুসারে বিনোদন করতে পারেন , অনেকে সারা রাত জেগে টি-ভি অনুষ্ঠান দেখেন , তাস খেলেন , সেদিন রাত্রে রাত জাগাও চীনের চান্দ্র বর্ষের শেষ রাতের একটি ঐতিহ্যিক রীতি। 

  বছরের অন্য সময় ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা মার শাসন মানতে হয় , একমাত্র ছুসির রাত্রে তাদের অভিভাবকদের কথা শুনতে হয় না , কাজেই সেদিন রাত্রে সর্বত্রই আনন্দের পরিবেশ বিরাজ করে ।