লা পা উত্সব

       চীনের চান্দ্র বর্ষের শেষ মাসকে লা ইউয়ে মাস বলা হয় । লা ইউয়ে মাসের অষ্টম দিন হচ্ছে লা পা উত্সব । লা পা উত্সব চীনের হান জাতির একটি ঐতিহ্যিক উত্সব , এই উত্সবকে বসন্ত উত্সবের প্রারম্ভও বলা যায় ।  

 চীনের প্রাচীনকালের নথিপত্রে বলা হয়েছে , লা পা উত্সব মূলতঃ প্রাচীনকালের দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন অনুষ্ঠান থেকে আসে ।প্রাচীনকাল থেকেই চীন কৃষিকে গুরুত্ব দেয় । সুফলনের বছরে চীনারা মনে করতেন সুফলন স্বর্গের দেবতার সাহায্যের ফল , কাজেই তারা বছর শেষে বিরাটাকার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পূজা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন , বছরের শেষের এই পূজাকে লা চি বলা হয় , পূজার পর সবাই এক সংগে নতুন চাউলের জাউ খান । পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠান পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে পরিণত হয় । খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চান্দ্র বর্ষের শেষ মাসের অষ্টম দিনকে লা পা উত্সবের দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয় । 

বৌদ্ধ ধর্ম চীনে অনুপ্রেবেশের পর চান্দ্র বর্ষের শেষ মাসের অষ্টম দিন বৌদ্ধদেব শাক্যমুনির বৌদ্ধ হওয়ার কাহিনী যুগ যুগ ধরে প্রচারিত হয়ে থাকে , কাহিনীটির মর্ম হলো শাক্যমুনি বৌদ্ধ হওয়ার আগে দেবতার উদ্দেশ্যে অনেক বছর শাস্ত্র পড়ে প্রণাম করেন , ক্ষুধায় তার শরীর একেবারে দুর্বল হয় । তিনি এই ধরনের কষ্ট আর সহ্য করতে পারেন না , তাই তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র পড়া ও প্রার্থনার প্রচেষ্টা বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । ঠিক এই সময় একজন পশুপালক মেয়ে তাকে দুধ ও জাউ খাওয়ালেন , পেট ভরে খাওয়ার পর শাক্যমুনির শরীর ভালো হয় , তিনি পিপুল গাছের নীচে বসে বৌদ্ধ শাস্ত্র পাঠ করতে শুরু করেন , সেই বছরের শেষ মাসের অষ্টম দিন শাক্যমুনি বৌদ্ধ হলেন । এই ঘটনা স্মৃতির জন্য বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছরের এই দিন চাল ও ফল দিয়ে জাউ তৈরী করে বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন , এই জাউকে সবাই লা পা জাউ বলেন । 

চীনাদের লা পা জাউ খাওয়ার ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশী দীর্ঘ। সুং রাজবংশের সময় থেকেই চীনারা জাউ খাওয়ার মাধ্যমে এই উত্সব উদযাপন করতে শুরু করেন । বছরের শেষ মাসের অষ্টম দিন রাজপ্রাসাদ , সরকারের বিভিন্ন বিভাগ , মন্দির আর প্রত্যেক পরিবারে লা পা জাউ রান্না করে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর পরিবারের সবাই এক সংগে লা পা জাউ খান । সেই দিন চীনারা আত্মীয়সজন ও বন্ধুদের লা পা জাউ উপহারও করেন । 

লা পা জাউ বিভিন্ন ধরনের ডাল ও চাল দিয়ে তৈরী করা হয় , এর মধ্যে প্রধান প্রধান ডাল ও চাল হলো লাল বিন , সবুজ বিন , হাইপ্যাসনথ বিন , মটর বিন ও সীম আর সাধারণ চাল , জোয়ার , হলুদ জোয়ার , আঠালো চাল , গম , জই ও ভুট্টা । জাউ তৈরীর সময় নিজের পছন্দমতো আট ধরনের ডাল ও চাল বেছে নিতে পারেন । 

লা পা জাউ রান্নার সময় কিছু শুকানো ফলও দেয়া হয় । যেমন শুকনা পিচ , এপ্রিকোট , আখরোট , কুল , চীনা বাদাম , চেষ্টনাট , প্যাসিমাম গাছের ফল , তরমুজের বীজ , পদ্মফুলের বীজ , পাইন গাছের বীজ আর শুকানো নাসপাতি ও আঙুর ইত্যাদি । 

লা পা জাউয়ের এই সব উপকরণ একসংগে পানিতে রেখে মৃদু আগুনে সিদ্ধ করা হয় , জাউ যখন আঁঠা আঁঠা হয় , তখন জাউর মধ্যে কিছু চিনি , গোলাপ ফুলের রস দেয়া হয় । কোনো কোনো পরিবারে লা পা জাউ রান্নার সময় কোনো কালো রংয়ের ডাল ব্যবহার করে না , কাজেই তাদের তৈরী জাউ সাদা । বছরের শেষ মাস শীতকালে , বাইরে বরফ পড়ে , নদীর পানি শীতে বরফ হয় , এই সময় বাড়ীর সকল সদস্য এক সংগে বসে গরম মিষ্টি লা পা জাউ খাওয়া সত্যিই এক আনন্দের ব্যাপার । 

রাজধানী পেইচিংয়ের অধিবাসীরা লা পা উত্সবকে চান্দ্র বর্ষের নববর্ষ উত্সব অর্থাত বসন্ত উত্সব আগমনের প্রতীক মনে করেন । পেইচিংয়ে একটি ছড়ার গানে বলা হয়েছে , বুড়ো মা আপনি মন খারাপ করবেন না , লা পা উত্সবের পরই নববর্ষ আসে , লা পা জাউ খাওয়ার অল্প কয়েক দিন পরই রন্ধন দেবতাকে বিদায় দেয়ার উত্সব । চীনে চান্দ্র বর্ষের শেষ মাসের ২৩তমো দিন রন্ধন দেবতাকে বিদায় দেয়ার উত্সব , এই উত্সব উদযাপনের পর নববর্ষ সত্যই ঘনিয়ে আসছে। 

লা পা উত্সবে লা পা জাউ খাওয়া ছাড়া উত্তর চীনের অধিবাসীরা সেই দিন লা পা রসুনও তৈরী করেন । লা পা রসুন তৈরীর পদ্ধতি খুব সহজ , রসুনের বাইরের খোসা ছাড়িয়ে একটি পাত্রে রাখেন , তার পর রসুনের উপর ভিনিগার ঢেলে দেন যাতে রসুন সম্পূর্ণভাবে ভিনিগারের মধ্যে থাকে , তার পর পাত্রের মুখ বন্ধ করে পাত্রটি ঘরের এক গরম জায়গায় রাখেন । বিশ-বাইশ দিন পর অর্থাত বসন্ত উত্সবের আগের দিন সন্ধ্যায় চিয়াও চি খাওয়ার সময় চীনারা সাধারণতঃ ভিনিগায় ভিজানো রসুন খান এবং মশলা হিসেবে চিয়াও চি বা মোমোর সংগে ভিনিগার খান। ভিনিগারের মধ্যে ভিজানো রসুন দেখতে সবুজ রঙের দামী পাথরের মতো সুন্দর , খেতে খুব সুস্বাদু ।