চীনের চান্দ্র বর্ষের প্রথম মাসের পনেরোতম দিন চীনের ঐতিহ্যিক ইউয়েন সিয়াও উত্সব , এই উত্সব উদযাপনের পর চীনের বসন্ত উত্সব উদযাপন সমাপ্ত হয় ।
ইউয়েন সিয়াও উত্সবের অন্য নামও আছে , যেমন ইউয়েন সি , ইউয়েন ইয়ে ও শান ইউয়েন উত্সব । চীনের চান্দ্রবর্ষের ১৫ই জানুয়ারী হচ্ছে নতুন বছরের প্রথম পুর্ণিমার দিন , সেই দিন রাত্রে চীনে প্রাচিনকাল থেকেই রঙীন বাতি ঝুলানোর প্রথা আছে , কাজেই ইউয়েন সিয়াও উত্সবের আরেক নাম হচ্ছে লন্ঠন উত্সব ।
লন্ঠন উপভোগ আর ইউয়েন সিয়াও নামে এক ধরনের খাবার খাওয়া ইউয়েন সিয়াও উত্সব উদযাপনের দুটি প্র্রধান রেওয়াজ । ইউয়েন সিয়াও উত্সব সম্পর্কিত একটি উপকথায় বলা হয়েছে , খৃষ্টপূর্ব ১৮০ সালে চীনের পশ্চিম হান রাজবংশের রাজা হান উন তি চান্দ্র বর্ষের ১৫ই জানুয়ারী রাজা হয়েছেন । এই তাত্পর্যময় দিন স্মরণের জন্য তিনি এই দিনকে লন্ঠন উত্সব হিসেবে স্থির করেন । প্রতি বছরের এই দিন হান উন তি রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সাধারণ অধিবাসীদের সংগে লন্ঠন উত্সব কাটান । সে দিন রাত্রে ছোট বড় রাস্তায় আর প্রত্যেক বাড়ীর সামনে নানা ধরনের রঙীন বাতি জ্বালানো হয় । খৃষ্টীয় ১০৪ সালে ইউয়েন সিয়াও উত্সব আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের গুরুত্বপূর্ণ উত্সবগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয় , সেই সময় থেকে চীনারা আরো ধুমধামে এই উত্সব উদযাপন করতে শুরু করেন । নিজের বাড়ীর সামনে বাতি ঝুলানো ছাড়া বড় বড় রাস্তা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নানা ধরনের লন্ঠন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয , সেদিন আবালবৃদ্ধবনিতা সারা রাত ঘুরে ঘুরে লন্ঠন উপভোগ করেন , লন্ঠনে লেখা ধাঁধার কথা চিন্তা করেন এবং ড্রাগন নাচ দেখেন । ঐতিহাসিক তথ্য থেখে জানা গেছে , খৃষ্টীয় ৭১৩ সালে থান রাজবংশের আমলে রাজধানী ছান আন অর্থাত আজকের সি আন শহরে সাত মিটার উচু একটি লন্ঠন পাহাড় তৈরী করা হয়েছিল , এতে ছোট-বড় মোট ৫০ হাজারটি লন্ঠন ছিল ।
ইউয়েন সিয়াও উত্সবের সময় ঝুলানো বাতিগুলো রঙীন কাগজ দিয়ে তৈরী করা হয় । বাতিগুলো পাহাড় , নদী , বিভিন্ন স্থাপত্যকর্ম , ফুল ও পশুপাখির আকারে তৈরী হয় । এই সব বাতির মধ্যে ঘুরন্ত ঘোড়ার বাতি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ । ঘুরন্ত ঘোড়ার বাতি এক ধরনের খেলনা-বাতি , এই লন্ঠন কয়েকটি কাগজের তৈরী ঘোড়া আছে , ঘোড়ার নীচে ইমপেলার ব্যবস্থা আছে , লন্ঠনের মোম জ্বালানোর পর গরম বাষ্প উপরে উঠার সংগে সংগে ইমপেলারগুলো ঘুরতে থাকে , সংগে সংগে ইমপেলার উপরের কাগজের ঘোড়াগুলোও ঘুরতে শুরু করে , লন্ঠনের ঢাকনা থেকে দর্শকরা দেখেছেন ভিতরের ঘোড়াগুলো জীবন্তভাবে ঘুরছে , সবাই এই ধরনের লন্ঠন পছন্দ করেন ।
চীনে ইউয়েন সিয়াও উত্সবে ইউয়েন সিয়াও খাওয়ার অভ্যাস আছে । ইউয়েন সিয়াও এক ধরনের মিষ্টি খাবার । প্রাচীনকাল থেকেই অর্থাত সুং রাজবংশ থেকে চীনারা এই ধরনের খাবার খেতে শুরু করেন । ইউয়েন সিয়াও হচ্ছে বিনী চালের গুড়া দিয়ে তৈরী ছোট গোল গোল খাদ্যবন্তু , এগুলোর ভিতরে চিনি মেশানো নানা ধরনের মিষ্টিপুর দেয়া হয় । ইউয়েন সিয়াও তৈরীর পর গরম পানিতে সিদ্ধ করা হয় , সিদ্ধ করা ইউয়েন সিয়াও নরম ও মিষ্টি । উত্তর চীনের অধিবাসীরা এই ধরনের খাবারকে ইউয়েন সিয়াও বলেন , দক্ষিণ চীনের অধিবাসীরা তাকে ‘ থান ইউয়েন ’ বা ‘ থান থুয়ান ’ বলেন ।
ইউয়েন সিয়াওয়ের মিষ্টিপুরের প্রকার সংখ্যা প্রায় ত্রিশ । যেমন টক ফল ও চিনি মেশানো পুর , মিষ্টি কুলের পুর , লাল ডালের গুড়া ও চিনি মেশানো পুর , কালো তীলের গুড়া ও চিনির পুর , চকলেটের পুর আর দুধ মেশানো চিনির পুর ইত্যাদি । দক্ষিণ চীনের হুনান প্রদেশের থান ইউয়েন মিষ্টি ও সুগন্ধ , পূর্ব চীনের চেচিয়ান প্রদেশের নিন পো শহরের থান ইউয়েনের পুর বেশী , বাইরের আঠালো চালের রেপার পাতলা , সাংহাই শহরের ছোট থান ইউয়েন আর পেইচিংয়ের তিল ও দুধ মেশানোর ইউয়েন সিয়াও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ।
ইউয়েন সিয়াও উত্সবে লন্ঠন জ্বালানো ও ইউয়েন সিয়াও খাওযা ছাড়াও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । যেমন রণ -পা , ইয়ানকো নাচ আর ড্রাগল নাচ ইত্যাদি । বিশেষ করে ড্রাগন নাচ চীনের এক ঐতিহ্যিক নাচ , পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেখানে প্রবাসী চীনা ও বিদেশী চীনা আছেন , সেই সব জায়গায় বসন্ত উত্সব ও অন্যান্য ঐতিহ্যিক উত্সবের সময় ড্রাগন নাচ দেখানো হয় । দক্ষিণ চীন ও উত্তর চীনের ড্রাগন নাচের মধ্যেও তফাত আছে । দক্ষিণ চীনের ড্রাগন নাচ সাধারণতঃ দুইজন লোক নাচেন , নাচের শৈলী বিচিত্র ও পরিবর্তনশীল । কিন্তু উত্তর চীনের ড্রাগন নাচ সাধারণতঃ দশ-বারোজন তথা কয়েক লোক এক সংগে নাচেন , নাচের সময় ঐতিহ্যিক লোকসংগীত বাজানো হয় , নৃত্যশিল্পীর প্রানচঞ্চল ড্রাগন নাচ দেখে দর্শকরাউল্লাস প্রকাশ করেন , লন্ঠন উত্সবে সর্বত্রই আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করে ।
|