চীনের চান্দ্র বর্ষের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন চীনের ঐতিহ্যিক ছিছাও উত্সব । উপকথায় বলা হয়েছে , এই দিন আকাশের আলটাইর নক্ষত্র ও অভিজিত নক্ষত্রের মিলনের দিন । এই উত্সব সম্পর্কে একটি কাহিনী এখনো চীনাদের মুখে মুখে ।
প্রাচীনকালের একদিন নীল আকাশে কোনো মেঘ নেই । স্বর্গীয় রাজা মনে করেন আকাশে শুধু একটি নীল রঙ আছে বলেই তা সুন্দর নয় , তাই তিনি তার সাতটি মেয়েকে কাপড় বুনে আকাশের জন্য একটি পোশাক তৈরী করার আদেশ দিলেন । সাতটি মেয়ের মধ্যে ছয়টি মেয়ের বুনা কাপড়ের রঙ সাদা অথবা ধুসর , দেখতে সুন্দর নয় , শুধু তাদের কনিষ্ঠ বোন এক বুদ্ধিমতী মেয়ে , মেয়েটি বাগানে এক ধরনের সাত রঙের ফুল আবিষ্কার করেছেন । তিনি বাগান থেকে প্রচুর এই ধরনের সাত রঙের ফুল তুলে ফুলগুলো চুর্ণবিচুর্ণ করে ফুলের রস বের করলেন । তার পর তিনি ফুলের রস সুতার সংগে মিশিয়ে রঙীন সুতা তৈরী করেন এবং এই সুতা দিয়ে রংবেরংয়ের কাপড় বুনেছেন । অন্য ছয় বড় বোন ছোট বোনের বুনা সুন্দর কাপড় দেখে তার প্রশংসা করেন এবং এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে দিনের বেলায় আকাশ সাদা রঙের কাপড় পরে , বৃষ্টির দিন ধুসর রঙের কাপড় পরে , ভোর ও সন্ধ্যা বেলায় আকাশ রঙীন কাপড় পরে । রাজা এই খবর পেয়ে খুশি মনে তার কনিষ্ঠ কন্যাকে চিনুই অর্থাত বুনন ললনা আখ্যা দিলেন ।
বুনন ললনা রোজ কাপড় বুনতে থাকেন । ক্লান্ত হলে মাথা নীচু করে আকাশের নীচের দৃশ্য দেখেন । এক দিন এক যুব কৃষক মেয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট করলো , তিনি দেখেছেন এই কৃষক সব সময় একা ক্ষেতের কাজ করেন , বিশ্রামের সময় শুধু পাশে দাঁড়ানো গরুর সংগে কথা বলে , মেয়ের মনে মায়া জাগল , এই কৃষকের নাম নিউ লান ।
একদিন হঠাত তার বুড়ো গরু তাকে বলল , আগামীকাল সপ্তম মাসের সপ্তম দিন , স্বর্গীয় রাজার সাত মেয়ে আগামীকাল আকাশ থেকে নেমে নদীতে গোসল করতে আসবেন । আপনি বুনন ললনার কাপড় লুকিয়ে রাখবেন , মেয়েটি পরে আপনার স্ত্রী হবেন । গরুর কথা শুনে নিউ লান খুব খুশী , তিনি গরুর কথা অনুসারে মেয়েটির কাপড় লুকানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ।
পরদিন সকালে নিউ লান নদীর তীরের শরবনে লুকিয়ে অপেক্ষা করেন । একটু পর আকাশ থেকে সাত টুকরো মেঘ ভেসে আসে , প্রত্যেক টুকরো মেঘের উপর একটি পরী বসেন । সাতজন পরী নদীর তীরে এসে কাপড় খুলে নদীতে গোসল করতে শুরু করেন । এই সময় নিউ লান এক লাফে সবচেয়ে কনিষ্ঠ পরী অর্থাত বুনন ললনার কাপড় নিয়ে শরবন ত্যাগ করলো । শরবনের পানির শর শর শব্দ শুনে নদীতে গোসলরত সাত পরী ভয় পেয়ে নদী থেকে তীরে উঠল , ছয়জন পরী নিজের কাপড় পরে আকাশের দিকে উড়ে গেল , শুধু বুনন ললনা নিজের কাপড় পান নি বলে নদীর তীরে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছেন । এই সময় নিউলান তার কাছে গিয়ে আমতা আমতা করে বুনন ললনাকে বল্লেন, তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হও , তাহলে আমি তোমার জামা কাপড় ফেরত দিব । বুনন ললনা দেখেছেন , যে ছেলে তার সংগে কথা বলছেন , সে ছেলে ঠিক নিজে আকাশ থেকে আবিষ্কার করা সেই যুব কৃষক , তাই মেয়েটি তাকে বিয়ে করতে রাজী হলেন ।
সেদিন রাত্রে গরুর সামনে নিউলান ও বুনন ললনার বিয়ে হলো । দু বছর পর তাদের একটি ছেলে ও এক মেয়ে হলো । স্বামী জমি চাষ করেন , স্ত্রী কাপড় বুনেন এবং বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন , তাদের জীবন অত্যন্ত সুখী ।
জীবন সুখী হলে সময় খুব তাড়াতাড়ি যায় । সাত বছর পার হয়ে গেল । আকাশে একদিন পৃথিবীর এক বছরের সমান । প্রতি সাত দিন পর পর স্বর্গীয় রাজা তার সাতটি মেয়ের সংগে একবার দেখা করেন । তিনি যখন জানতে পেরেছেন যে তার কনিষ্ঠ মেয়ে আকাশে ফিরে আসে নি এবং পৃথিবীর এক কৃষকের সংগে তার বিয়ে হয়েছে , তিনি ভীষণ রাগ করলেন । বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন তিনি তার স্বর্গীয় সৈনিকদের পৃথীবী থেকে তার বুনন ললনাকে ধরে আকাশে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন । স্বর্গীয় সৈনিকরা নিউ লানের হাত থেকে বুনন ললনাকে নিয়ে গেলো । স্ত্রীর পেছন পেছন নিউলান তার একজোড়া সন্তানকে দুটি বড় ঝুড়িতে রেখে কাঁধে নিয়ে রওয়ানা হলেন । তার গরু নিজের মাথার একটি সিং দিয়ে একটি উড়ন্ত নৌকা তৈরী করে , নিউলান ও তার ছেলেমেয়ে এই উড়ন্ত নৌকা যোগে আকাশের দিকে ছুটে যায় । সন্তান ও নিউলানের চিত্কার শুনে বুনন ললনা স্বর্গীয় সৈনিকদের বাধা উপেক্ষা করে স্বামী ও ছেলেমেয়ের সংগে মিলনের চেষ্টা করেন । ঠিক এই সময় স্বর্গীয় রাজা হঠাত তার এক বাহু বাড়িয়ে মুহুর্তের মধ্যে এক ছায়াপথ তৈরী করলেন । ছায়াপথটি ঠিক নিউলান ও বুনন ললনার মধ্যে । এই সময় আকাশ থেকে প্রচুর দোয়েল পাখি জড় হয়ে নদীর উপর এক সেতু তৈরী করলো । নিউ লান ও বুনন ললনা এই দোয়েল পাখির সেতুতে দাঁড়িয়ে মিলিত হলেন । স্বর্গীয় রাজা নিউলান ও বুনন ললনাকে প্রতি বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন রাত্রে দোয়েল পাখির সেতুতে একবার মিলনের অনুমতি দিলেন ।
এর পরবর্তীকালে চীনে এই নিয়ম চালু হয়েছে যে প্রতি বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন অর্থাত চাতুর্য প্রার্থনা দিবস হচ্ছে অল্পবয়সী মেয়েদের বুনন ললনার কাছ থেকে বুনন কৌশল শেখার দিন । তাদের হাতে রঙীন সুতা ও সাতটি সুচি আছে , যারা খুব সহজেই সাতটি সুইয়ের ছিদ্রে রঙীন সুতা পার করতে পারেন , তারা বুদ্ধিমতী ও কাজের মেয়ে । জানা গেছে , সেদিন রাত্রে বাচ্চারা আঙুরের মাচার নীচে নিউলান ও বুনন ললনার কথাবার্তাও শুনতে পায় ।
|