খ্রীষ্টানদের বড় দিনের মতো বসন্ত
উত্সব চীনাদের পক্ষে বছরের সবচেয়ে
বড় উত্সব । যুগ পরিবর্তনের সংগে
সংগে বসন্ত উত্সবের বিষয়বস্তুর
কিছু পরিবর্তন হয়েছে , নাগরিকদের
বসন্ত উত্সব পালনের কায়দারও কিছু
পরিবর্তন হয়েছে , কিন্তু চীনা
নাগরিকদের জীবনে ও চিন্তাভাবনায়
বসন্ত উত্সবের অবস্থানের এখনো
পরিবর্তন হয় নি ।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে চীনাদের
বসন্ত উত্সবের ইতিহাস চার হাজার
বছরেরও বেশী দীর্ঘ । তবে তখন
এই উত্সবের নাম বসন্ত উত্সব
ছিল না , উত্সবের দিনতারিখও
স্থির করা হয় নি । খৃষ্টপূর্ব
দু হাজার এক শ’ সালের সময় তখনকার
অধিবাসীরা বৃহষ্পতিগ্রহের একবার
প্রদক্ষিণের সময়কে এক সুই বলে
অভিহিত করতেন , সেই সময় বসন্ত
উত্সবের নাম ছিল সুই । খৃষ্টপূর্ব
এক হাজার সালের কাছাকাছি সময়
তখনকার অধিবাসীরা বসন্ত উত্সবকে
চীনা ভাষায় ‘ নিয়েন ’ বলে ডাকতেন
। ‘ নিয়েন ’ অর্থ বছর , তবে
তখনকার বছরের অর্থ ছিল সুফসল
। যে বছর খাদ্যশস্যের ভালো
ফলন হয়েছে , সেই বছরকে ফসলের
নিয়েন বলা হতো , যে বছর খুব
ভালো ফসন হয়েছে , সেই বছরকে
ভালো ফসলের নিয়েন বলা হতো ।
চীনের ঐতিহ্যিক রীতিনীতি অনুসারে চীনের বসন্ত উত্সব চীনের চান্দ্রবর্ষের শেষ মাসের ২৩ তমো দিন থেকে নতুন বছরের প্রথম মাসের ১৫তমো দিন অর্থাত্ লন্ঠন উত্সব পর্যন্ত স্থায়ী হয় , বসন্ত উত্সব উদযাপনের সময় প্রায় তিন সপ্তাহ । এই সময়পর্বে বসন্ত উত্সবের আগের দিন অর্থাত পুরনো বছরের শেষ দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন অর্থাত বসন্ত উত্সবের প্রথম দিন হচ্ছে বসন্ত উত্সবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই দিন ।
বসন্ত উত্সবকে স্বাগত জানানোর জন্য চীনের শহরাঞ্চল ও পল্লী অঞ্চলের অধিবাসীরা নানা ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ করেন । চীনের পল্লী অঞ্চলে প্রস্তুতির কাজ বছরের শেষ মাসের প্রথম দিক থেকেই শুরু হয় । কৃষকরা বাড়ীঘর পরিষ্কার করেন , লেপতোষক ধুয়ে পরিষ্কার করেন , বাজার থেকে বসন্ত উত্সবের খাওয়া ও মেহমানকে খাওয়ানোর খাদ্যদ্রব্য কিনেন , যেমন মিষ্টিজাতীয় খাদ্য , কেক , ফলমুল , মাছ-মাংস ইত্যাদি । বড় বড় শহরে উত্সবের প্রস্তুতিও উত্সবের অনেক দিন আগে থেকে শুরু হয় । সাংস্কৃতিক বিভাগগুলো ও বিভিন্ন শিল্পী দল উত্সবকালের সাংস্কৃতিক কর্মসূচী তৈরীর কাজে ব্যস্ত, টেলিভিশন কেন্দ্র বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয় , বিভিন্ন পার্কে নানা ধরনের মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেয় আর বিভাগীয় দোকানগুলো নাগরিকদের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তথা বিদেশ থেকে পন্যদ্রব্য জোগাড় করার প্রচেষ্টা করে । একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে , বসন্ত উত্সবকালে চীনাদের কেনাকাটা তাদের গোটা বছরের কেনাকাটার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশী ।
চীন একটি বড় দেশ , কাজেই বিভিন্ন জায়গায় বসন্ত উত্সব উদযাপনের রীতিনীতি ভিন্ন । তবে বসন্ত উত্সবের আগের দিন রাত্রে অর্থাত্ পুরনো বছরের শেষ দিন রাত্রে পরিবারের সবাই এক সংগে মিলে বছরের শেষ খাওয়া সম্পন্ন করার প্রথা সমগ্র দেশে প্রায় একই । দক্ষিণ চীনে বছরের শেষ খাবারের টেবিলে দশ-বারোটি তরিতরকারী আছে , এগুলোর মধ্যে টোফু অর্থাত্ সয়াবীনের দই ও মাছ থাকতে হবে । কারণ এই দুটি খাবারের চীনা উচ্চারণের সংগে ঠিক সমৃদ্ধির চীনা শব্দের উচ্চারণের অনেক মিল আছে । এতে নতুন বছরে চীনাদের আশা-আকাংখা প্রতিফলিত হয়েছে । উত্তর চীনে বছরের শেষ খাবারের টেবিলে চিয়াও চি নামক এক খাবার অবশ্যই থাকতে হবে । সেদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই এক সংগে মিলে চিয়াও চি তৈরী করেন । চিয়াউ চি চীনের এক জনপ্রিয় খাবার , চিয়াও চি মাংসের পুর দেয়া এক কুলী পিঠে , বছরের শেষ রাতে পরিবারের সকল সদস্য মিলিতভাবে চিয়াও চি তৈরী করে ফুটন্ত পানির মধ্যে সেদ্ধ করে ভিনেগা ও অন্যান্য মশলার সংগে খান ।
বছরের শেষ রাতে সারারাত জেগে কাটানোও বসন্ত উত্সবের এক রেওয়াজ । সেই রাতে লোকেরা নাচগান ও গল্প করার মধ্য দিয়ে বছরের শেষ রাত কাটান । অতীতে বছরের শেষ রাতে নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য নাগরিকরা পটকাবাজি ফাটাতেন , নিরাপত্তা ও পরিবেশ দুষনের কারণে পেইচিংসহ চীনের কিছু বড় শহরে পটকাবাজি ফাটানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে । বসন্ত উত্সবের প্রথম দিন অর্থাত চান্দ্র বর্ষের প্রথম দিন সকালে পরিবারের সবাই নতুন জামা-পোশাক পরে মেহমানদের স্বাগত জানান অথবা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে যান । সেদিন সবাই পরস্পরের সংগে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং চা , বাদাম ও মিষ্টি খেয়ে গল্প করেন । চীনে এরকম রেওয়াজও আছে যে গত এক বছরে যদি আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ঝগড়া বা গন্ডগোল হয় , বসন্ত উত্সবের সময় এক পক্ষ আরেক পক্ষের বাড়িতে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গেলে দুজনের বিরোধ মিটে গেছে বলে মনে করা হয় ।
বসন্ত উত্সবের কর্মসুচী বৈচিত্র্যময় । স্থানীয় অপেরা ও চলচ্চিত্র অনুষ্ঠান , সিংহনাচ , বিভিন্ন ধরনের মেলা ইত্যাদি কর্মসুচীর কল্যানে সর্বত্রই উত্সবের আনন্দমুখর পরিবেশ বিরাজ করে । অবশ্য বেশীর ভাগ লোক বাড়িতে বসে টেলিভিশন কেন্দ্রের বসন্ত উত্সব উপলক্ষে তৈরী বিশেষ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ।
বসন্ত উত্সব চলাকালে বাড়ীর প্রবেশদ্বারে দ্বি-চরণ শ্লোক ও নতুন বছরের দেওয়াল চিত্র এঁটে দেয়া আর বাড়ীর ফটকে অথবা সদর দরজায় নানা ধরনের চীনা লন্ঠন ঝুলানোও বসন্ত উত্সবের এক রেওয়াজ । বসন্ত উত্সবের আগে বাজারে প্রচুর দেওয়াল চিত্র ও দ্বি-চরণ শ্লোক পাওয়া যায় , নাগরিকদের সুখী জীবনের ছবি , সুন্দর ফুল ও মনোরম দৃশ্যের চিত্র অত্যন্ত জনপ্রিয় । বসন্ত উত্সবের লন্ঠন প্রদর্শনীও দেখার মতো , চীনা লন্ঠন চীনের এক ঐতিহ্যিক শিল্পকর্ম , সেগুলোর কোনোটার আকার খরগোসের মতো , কোনোটা ছাগলের মতো , কোনোটা টেলিভিশন কার্টুনের কোনো জনপ্রিয় চরিত্রের আকার ।
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সংগে সংগে চীনাদের বসন্ত উত্সব উদযাপনের উপায়ের পরিবর্তন হচ্ছে , এখন পর্যটনে যাওয়া চীনাদের বসন্ত উত্সবের ছুটি কাটানোর এক নতুন বিকল্প হয়েছে ।
|