পূর্ব চীনের
চিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংচৌর চিয়ানইং
জেলার এক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী
পরিবারে চিয়েনচেনের জন্ম ।
খৃষ্টীয় ৭০৮ সালে চিয়েনচেন
ছিয়ানআনে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহন
করে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাসী
হন । তার পরবর্তী ৪০ বছরে চিয়েনচেন
বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্র প্রচার করা
, মন্দির তৈরি ও বৌদ্ধদেবের
প্রতিকৃতি তৈরির কাজ করেন এবং
সন্ন্যাস ব্রতের শৃঙ্খলা ঘোষনা
করে ৪০ হাজার সন্ন্যাসী গ্রহণ
করেন , তাদের মধ্যে অনেকে বিখ্যাত
সন্ন্যাসী হন । পূর্ব চীনের
একজন বৌদ্ধধর্মের নেতা হিসেবে
চিয়েনচেনের প্রভাব যথেষ্ট ।
খৃষ্টীয় ৭৪৩ সালে জাপানী
সন্ন্যাসী রোনরুই ও ফুচাও চিয়েনচেনকে
জাপানে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে
আমন্ত্রন জানান । চিয়েনচেন
তাদের আমন্ত্রন গ্রহণ করে জাপানে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । তার
২১জন ছাত্র তার সঙ্গে জাপান
যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ।
কিন্তু চিয়েনচেনের প্রথম জাপান
সফর সরকারের হস্তক্ষেপের দরুণ
ব্যর্থ হয় ।
দ্বিতীয় বার জাপান সফরের জন্য
চিয়েনচেন সামরিক বোট কিনেন
। তিনি প্রচুর বৌদ্ধদেবের প্রতিকৃতি
, ওষুদপত্র ও খাবার সামরিক
বোটে নিয়ে রওয়ানা করেন । তার
সঙ্গে যাওয়া ছাত্রের সংখ্যা
৮৫জন । কিন্তু রওয়ানার অল্পদিন
পর সামরিক বোটটি প্রবল বাতাসে
ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তাই বোট মেরামতের
জন্য তারা আবার ফিরে আসতে বাধ্য
হন । বোট মেরামতের পর তার তৃতীয়
জাপান যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু
দুঃখের বিষয় হল বোটটি মূলভূভাগ
থেকে অদূরে সমুদ্রের নীচের
পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ক্ষতিগ্রস্ত
হয় বলে যাত্রা আবার ব্যর্থ
হয়।
তার জাপান যাত্রা তিন-তিনবার
ব্যর্থ হলেও চিয়েনচেন হতাশ
হন নি । খৃষ্টীয় ৭৪৪ সালে চিয়েনচেন
আবার জাপানে যেতে চেষ্টা করেন
। কিন্তু তখনকার সরকারের বাধায়
সে যাত্রাও আবার ব্যর্থ হয়
। খৃষ্টীয় ৭৪৮ সালে ৬১ বছর
বয়সী চিয়েনচেন ইয়ানচৌ থেকে
তার চতুর্থ জাপান যাত্রা শুরু
করেন । কিন্তু ঘুর্নিঝড়ে জাহাজের
দিকস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে জাহাজটি
দক্ষিণ চীনের হাইনান দ্বীপের
দক্ষিণাংশে পৌছে । জাহাজ হাইনান
থেকে আবার ইয়ানচৌ ফিরে আসে
। চিয়েনচেনের পঞ্চম জাপানযাত্রাও
ব্যর্থ হয় । পঞ্চমবার যাত্রার
পর চিয়েনচেনের জাপানী ছাত্র
রোনরুই আর চীনা ছাত্র সিয়ানইয়েন
রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান ।
চিয়েনচেন নিজে অতিরিক্ত ক্লান্তির
দরুণ অন্ধ হয়ে যান ।
আরো পাঁচ বছর পর ৬৬ বছরবয়সের
চিয়েনচেন আবার জাপান যাওয়ার
সিদ্ধান্ত নেন । খৃষ্টীয় ৭৫৩
সালের ১৯ই অক্টোবর তিনি ইয়ানচৌ
থেকে রওয়ান করেন । ২০ ডিসেম্বর
অন্ধ সন্ন্যাসী চিয়েনচেন জাপান
পৌছে জাপানের সন্ন্যাসীদের
সম্বর্ধনা পান । কিছু দিন পর
জাপান সরকার তার জন্য চিয়েনথাই
মন্দির তৈরি করে এবং তাকে বৌদ্ধধর্মের
শৃঙ্খলা ব্যাখ্যা করে সন্ন্যাসী
গ্রহণের অধিকার দেয় । খৃষ্টীয়
৭৫৬ সালে জাপান সরকার চিয়েনচেনকে
শীর্ষ সন্ন্যাসীর পদ দেয় ।
জাপান এই প্রথমবার একজন বিদেশী
সন্ন্যাসীকে এই পদ দিয়েছে ।
চিয়েনচেন ও তার ছাত্ররা জাপানে
‘থানলুইচাওদি’ নামে একটি মন্দির
নির্মান করেন । এই মন্দির বর্তমানে
জাপানের একটি বিখ্যাত মন্দির
। খৃষ্টীয় ৭৬৩ সালের মে মাসে
৭৬ বছর বয়সী সন্ন্যাসী চিয়েনচেন
জাপানে মৃত্যুবরণ করেন । তার
ছাত্ররা তার মৃতদেহ জাপানে
সমাহিত করেন ।
চিয়েনচেন জাপানে দশ বছর ছিলেন
। জাপানের সংস্কৃতির বিকাশ
আর চীন ও জাপানের সাংস্কৃতিক
আদান-প্রদানে চিয়েনচেনের অবদান
বিরাট । চিয়েনচেন চীনের থান
রাজবংশের সময় জাপানে গিয়েছেন
। তখন চীনের সংস্কৃতি দ্রুত
বিকাশ হয় । জাপান যাওয়ার সময়
চিয়েনচেন চীনের সূচিকর্মশিল্পী
, চিত্রশিল্পী ও দামীপাথর খোদাই
শিল্পী ও প্রচুর শিল্পকর্ম
সঙ্গে নিয়েছিলেন । চিয়েনচেন
যে সব শিল্পকর্ম জাপানে নিয়েছেন
, তা’ পরে জাপানের ‘থিয়েন পিং’
সংস্কৃতির একটি অংশে পরিণত
হয়েছে । জাপানের ‘থিয়েনপিং’
সংস্কৃতি বৌদ্ধধর্মের সংস্কৃতি
। জাপানে চিয়েনচেনের সবচেয়ে
বড় অবদান হলো বৌদ্ধধর্ম সংস্কৃতির
প্রসার । চিয়েনচেন যে চীনের
বৌদ্ধমন্দিরের স্থাপত্য রীতি
অনুসারে জাপানে ‘থানচাওতি’
মন্দির তৈরি করেন , তা’ জাপানের
বৌদ্ধমন্দিরের দৃষ্টান্তে পরিণত
হয় । চিয়েনচেন যাওয়ার আগে জাপানে
শুধু পিতল ও কাঠের বৌদ্ধ প্রতিকৃতি
ছিল । চিয়েনচেন যাওয়ার পর জাপানে
ল্যাক্যার বৌদ্ধপ্রতিকৃতি তৈরির
কাজ শুরু হয় । ল্যাক্যার বৌদ্ধপ্রতিকৃতি
জাপানের ‘থিয়েনপিন’ সংস্কৃতির
সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় শিল্পকর্ম
,চিয়েনচেনের মৃত্যুর পর তার
বসা অবস্থার একটি প্রতিকৃতি
এই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় ।
চিয়েনচেন চীনের ঐতিহ্যিক চিকিত্সা
পদ্ধতিও জাপানে নিয়েছেন । তিনি
জাপানের রাজার মার জন্য চিকিত্সা
করেছিলেন , অন্ধ হলেও চিয়েনচেন
সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ
দিতে পারতেন ।
চিয়েনচেন চীন ও জাপানের মৈত্রী
ও সাংস্কৃতিক আদান প্রদানে
বিরাট অবদান রেখেছিলেন । ১৯৭৩
সালে চীনের তখনকার উপপ্রধানমন্ত্রী
তেং সিয়াও পিং জাপান সফরকালে
‘থানচাওতি’ মন্দির পরিদর্শন
করেন এবং মন্দিরের প্রবীণ সন্ন্যাসীদের
চিয়েনচেনের প্রকৃতি চীনের প্রদর্শনের
অনুরোধ গ্রহণ করেন । ১৯৮০ সালের
১৯ এপ্রিল চিয়েনচেনের বসা অবস্থার
একটি প্রতিকৃতি চিয়েনচেনের
জন্মস্থান --চীনের চিয়ানসু
প্রদেশের ইয়ান চৌ শহরে প্রদর্শিত
হয় এবং স্থানীয় অধিবাসীদের
সাদর সম্বর্ধনা পায় ।
|