সুয়েনচুয়ান


    চীনে ‘ পশ্চিমযাত্রা ’ নামে একটি জনপ্রিয় উপন্যাস আছে । এই উপন্যাসে চার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর পশ্চিম স্বর্গে বৌধ ধর্মশাস্ত্র অন্বেষনের অলীক কাহিনী সবার জানা । তারা তাদের যাত্রায় অসংখ্য দৈত্য ও ভূতকে পরাজিত করে সাফল্যের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র পেয়েছেন । এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র থানসানচান হচ্ছেন প্রাচীন চীনের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক দূত সন্ন্যাসী সুয়েনচুয়ান ।  

 খৃষ্টীয় ৬০০ সালে চীনের থান রাজবংশে সুয়েনচুয়ানের জন্ম । তিনি ছোট বেলা থেকেই বুদ্ধিমান । তিনি বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র পড়তে পছন্দ করতেন । তার বয়স যখন এগার , সুয়েনচুয়ান বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র পড়তে শেখেন । তের বছর বয়সে তিনি চীনের সাংস্কৃতিক নগর লোইয়ানে গিয়ে সন্ন্যাসী হন । সন্ন্যাসী হওয়ার পর সুয়েনচুয়ান চীনের বিভিন্ন জায়গার বৌদ্ধশাস্ত্র পন্ডিতদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন । তার বয়স যখন ১৮ , তিনি বৌদ্ধধর্ম মহলের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হন। তিনি ভারতের বৌদ্ধধর্মের তিনটি শাস্ত্র ভালোভাবে আয়ও করেন ।  

সুয়েনচিয়ান বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্র ভালোভাবে আয়ত্ত করার পর বুঝতে পারেন যে তখনকার বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্রে কিছু বিষয়ে পরিপূর্ণ ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি । আরো ভালোভাবে বৌদ্ধধর্ম গবেষনার জন্য তিনি বৌদ্ধধর্মের উত্পত্তিস্থল-- ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ।  

খৃষ্টীয় ৬২৭ সালে সুয়েনচুয়ান তখনকার চীনের থান রাজবংশের রাজধানী ছানআন অর্থাত আজকের সিআন থেকে রওয়ানা হয়ে তার পশ্চিতযাত্রা শুরু করেন । ভারতের লান থুও মন্দির হলো বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে পুরনো মন্দির । সুয়েন চুয়ানের পশ্চিতযাত্রার সাত শ’ বছর আগে লান থুও মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় । এই কথা বলা যায় যে লান থুও মন্দির ভারতের বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে । এই মন্দির বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি তীর্থস্থান ।  

এক হাজার তিন শ’ বছর আগে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত ছিল । মধ্য চীন থেকে পাঁয়ে হেটে সুদূর ভারতে যাওয়া মোটেও সহজ কথা নয় । পথে নির্জন মরুভূমি ও আদিম বনাঞ্চল অতিক্রম করতে হয় এবং উত্তর-পশ্চিম চীনের তুষার পাহাড় পার হতে হয় । সব অসুবিধা অতিক্রম করে সুয়েনচুয়ান খৃষ্টীয় ৬২৯ সালের গ্রীষ্মকালে ভারতের উত্তর অংশে হাজির হন । তিনি ভারতে বৌদ্ধধর্মের পাঁচটি মন্দির পরিদর্শন করেন । 

খৃষ্টীয় ৬৩১ সালে সুয়েনচুয়ান ভারতের লানথুও মন্দিরে বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে শুরু করেন । পাঁচ বছর সে মন্দিরে অবস্থান করার সময় তিনি সেখানকার রক্ষিত সবগুলো ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন । তার পরের ছয় বছর সুয়েনচুয়ান ভারতের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেন । তিনি ভারতের দশ-বারোজন বৌদ্ধধর্ম পন্ডিতের কাছ থেকে ধর্মশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করে তখনকার একজন বিখ্যাত বৌদ্ধধর্ম পন্ডিতে পরিণত হন । ভারতের একটি বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র তর্ক অনুষ্ঠানে সুয়েনচুয়ান বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে নিজের উপলব্ধি বর্ণনা করেন এবং উপস্থিত সকল পন্ডিতদের প্রশ্নের উত্তর দেন। তখন থেকে ভারতের বৌদ্ধধর্ম মহলে সুয়েনচুয়ানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ।  

খৃষ্টীয় ৬৪৩ সালে সুয়েনচুয়ান চীনে ফিরে আসেন । তিনি ভারতে সংগ্রহ করা অনেক ধর্মশাস্ত্র ও বৌদ্ধ প্রতিকৃতি চীনে নিয়ে আসেন । তখনকার থান রাজবংশের রাজা থানথাইচুনের প্রতিনিধি সুয়েন চুয়ানকে স্বাগত জানিয়েছেন । সুয়েনচুয়ান রাজার রাজপ্রাসাদে তার সেবা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে রাজধানী ছিয়ানআনের হোনফু মন্দির বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্র চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু করেন। রাজার সমর্থনে সুয়েনচুয়ানের বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্র অনুবাদের কাজ দীর্ঘ ১৯ বছর স্থায়ী ছিল ।  

সুয়েনচুয়ান ১৯ বছরে ৭৫টি বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের মোট ১৩৩৫ খন্ড অনুবাদ করেন । এর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র ‘ তাপানরোচিনের ’ খন্ড সংখ্যা ছয় শ’ । সুয়েনচুয়ানের চীনা ভাষার মান বেশ উন্নত ছিলো । তিনি সংস্কৃত ভাষাও জানতেন , কাজেই তিনি ভারতের বৌদ্ধধর্মশাস্ত্রের আসল অর্থ পুরোপুরি প্রকাশ করতে পেরেছিলেন । তিনি তার অনুবাদকর্মে পঞ্চম শতাব্দীর সময়পর্বের ভারতের বৌদ্ধধর্মের প্রসার চমত্কারভাবে তুলে ধরেন । 

সুয়েনচুয়ান ধর্মশাস্ত্র অনুবাদের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন । চীনের বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে ফাসিয়ানচুন সুয়েনচুয়ানের উদ্যোগে সৃষ্টি হয় । ফাসিয়ানচুন বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা । তার জাপানী ছাত্র তাওচাও দেশে ফিরে যাওয়ার পর জাপানেও ফাসিয়ানচুন প্রতিষ্ঠা করেন । জাপানে ফাসিয়ানচুন এখনো প্রচলিত । তার কোরিয় ছাত্র ইউয়েনছেও দেশে ফিরে যাওয়ার পর বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করে কোরিয়ায় ফাসিয়ানচুন প্রতিষ্ঠা করেন। 

এই ১৯ বছরে সুয়েনচুয়ান নিজের পশ্চিমযাত্রার অভিজ্ঞতা অনুসারে ‘ তা থান সিইয়ু চি ’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেন । এই বই তিনি মুখে বর্ণনা করেন এবং তার ছাত্র পিয়েনচি সেসব কথা লিখে রাখতেন । এই ভ্রমণকাহিনীতে তার পশ্চিমযাত্রায় ভ্রমণ করা এক শতাধিক দেশের ইতিহাস , ভৌগলিক অবস্থা , জাতি , আবহাওয়া ,সম্পদ , সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুয়েনচুয়ানের এই রচনা এখনো আফগানিস্তান ,পাকিস্তান , ভারত আর গোটা মধ্য এশিয়ার ইতিহাস ও ভূগোল গবেষনার মূল্যবান দলিল । উনবিংশ শতাব্দী থেকে সুয়েনচুয়ানের রচিত তার পশ্চিতযাত্রার রচনা ফরাসী , ইংরাজী , জাপানী ও জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে । আধুনিক প্রত্নতত্ববিদরা এই রচনা অনুসারে প্রাচীন ভারত ও মধ্য এশিয়ার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পুরার্কীতি উদ্ধার ও গবেষনায় ভালো ফল পেয়েছেন । সুয়েনচুয়ানের পশ্চিমযাত্রার সাংস্কৃতিক প্রভাব তার তখনকার উদ্দেশ্য ছাড়িয়েছে । তার এই যাত্রা চীন তথা প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে । সুয়েনচুয়ান শুধু স্বীকৃত অনুবাদক ও বৌদ্ধধর্ম তত্ববিদ নন , তিনি প্রাচীন চীনের একজন মহান পর্যটকও । তিনি ১৭ বছরে ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এক শ দশটি দেশ সফর করেন। এই ধরনের যাত্রা পৃথিবীতেও বিরল । তার ভ্রমণকাহিনীগুলো বিশ্ববিখ্যাত রচনায় পরিণত হয়েছে ।  

সুয়েনচুয়ানের পশ্চিমযাত্রা সেই আমলে আলোড়ন সৃষ্টি করে । থান রাজবংশ থেকে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যিকরা সুয়েনচুয়ানের পশ্চিমযাত্রাকে মূল বিষয় হিসেবে গ্রহন করে নানা ধরনের সাহিত্য কর্ম তৈরি করেন । সুং রাজবংশে তার পশ্চিমযাত্রা সংক্রান্ত একটি কবিতাসংগ্রহ রচিত হয় । মিং রাজবংশে সাহিত্যিকরা বিশ্ববিখ্যাত পশ্চিমযাত্রা রচনা করেন । গত এক হাজার বছরে সুয়েনচুয়ানের পশ্চিমযাত্রার কাহিনী বহুল প্রচারিত হয় । তার কাহিনী চীনের সর্বস্তরের মানুষ জানেন ।