ছুচুয়ান ওয়ান


       চীন একটি সংযমী ও ক্ষমাশীল দেশ । অনেকের ধারনা , সংযম ও অন্য লোককে ক্ষমা করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে । নিজের মনও শান্ত হবে । প্রাচীন চীনের ছুচুয়ানওয়ানের টুপির ফিতা ছেড়ার গল্প আমাদের এই সত্য বলে যে , আপনি যদি নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রন করে অন্য লোককে ক্ষমা করেন এবং অন্যদের দয়া দেখান , তাহলে অবশেষে ভালো ফল পাবেন । 

 খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর বসন্ত-শরতের আমলে চীনে অনেক ছোট ছোট রাজ্য ছিল। ছুরাজ্যের রাজা ছুচুয়ানওয়ান এক দয়ালু ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি । তার শাসনে ছুরাজ্য ক্রমেই শক্তিশালী হয় । 

একদিন ছুচুয়ানওয়ান এক বিরাটাকার ভোজসভার আয়োজন করে তার মন্ত্রীদের আপ্যায়ন করেন । রাজার উপপত্নীরাও এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সবাই একসঙ্গে মদ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাচগান উপভোগ করেন । ভোজানুষ্ঠান সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে । সূর্যাস্তের পর ঘরে ক্রমেই অন্ধকার হয় । কিন্তু মন্ত্রীরা চলে যেতে চান না । ছুচুয়ানওয়ান মোমবাতি জ্বালিয়ে অব্যাহতভাবে মদ খাওয়ার আদেশ দেন । মোমবাতির আবছা আলোয় ছুচুয়ানওয়ান নিজের দুজন সবচেয়ে প্রিয় উপপত্নী মাইচি ও সুইচিকে মন্ত্রীদের মদ পরিবেশনের নির্দেশ নিলেন । 

হঠাত প্রবল বাতাসে ঘরের সব মোমবাতি নিভে গেল । ঘরে পুরোপুরি অন্ধকার । এই সময় উপপত্নী সুইচি অনুভব করেন , একজন পুরুষ তার হাত ধরছে , লজ্জায় ও রাগে সুইচি হাত তুলে লোকটির টুপির ফিতা ছিড়ে দিলেন । তারপর সুইচি রাজার সামনে গিয়ে বলেন , এইমাত্র একজন মন্ত্রী আমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করেছেন , আমি তার টুপির ফিতা ছিড়ে দিয়েছি । মোমবাতি আবার জ্বালানোর পর আপনি দেখবেন , যার টুপির ফিতা নেই , আপনি তাকে শাস্তি দেবেন । ছুচুয়ানওয়া সুইচির কথা শুনে উচ্চস্বরে বল্লেন , অন্ধকারে মদ খাওয়া মজার ব্যাপার , আমার খুব ভালো লাগে , তোমরা মোমবাতি জ্বালাবে না । সবাই অন্ধকারে অব্যাহতভাবে মদ খায় ও আলাপ করছিলো । একটু পর ছুচুয়ানওয়ান সবাইকে জিজ্ঞেস করেন , আজ আপনারা আমার সঙ্গে মদ খেয়েছেন , আপনারা কি আনন্দ বোধ করেছো ? সবাই রাজাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন , তারা খুব খুশী। ছুচুয়ানওয়ান আবার বলেন , আপনারা কি সত্যই আনন্দ বোধ করেছেন ? আপনারা যদি আনন্দে টুপির ফিতা ছিড়ে না দেন , তাহলে প্রমাণিত হয় যে আপনারা যথেষ্ঠ আনন্দ পান নি। রাজার কথা শুনে মন্ত্রীরা পর পর নিজের টুপির ফিতা ছিড়ে দিলেন । এই সময় রাজা মোমবাতি আবার জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন । মন্ত্রীরা একে অপরের ফিতা ছেড়া টুপি দেখে হেসে উঠলেন । তারা আবার মদ খেতে শুরু করেন , ভোজসভা পরদিন ভোরবেলা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল ।  

নিজের রুমে ফিরে সুইচি খুব রাগ করেন । তিনি অভিযোগ করে বলেন , রাজা ইচ্ছাকরে তার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা মন্ত্রীকে রক্ষার জন্য সব মন্ত্রীর টুপির ফিতা ছেড়ার প্রস্তাব করেন । তখনকার আইন অনুসারে যদি কেউ রাজার উপপত্নীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে , তাহলে তার মৃত্যুদন্ড হবে । সুইচি বলেন , রাজা আপনি মন্ত্রীদের এই মারাত্মক পাপ ক্ষমা করেছেন , পরবর্তীকালে তারা আপনার বিরুদ্ধে খারাপ কাজ করার সাহস পাবে । ছুচুয়ানওয়ান হেসে বল্লেন , মন্ত্রীদের খুশী করার জন্যই আমি তাদের এখানে মদ খেতে আমন্ত্রন জানিয়েছি। মদ খাওয়ার পর নেশা অবস্থায় কিছু খারাপ ব্যবহার করা স্বাভাবিক ব্যাপার । আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে এই মন্ত্রীকে শাস্তি দিই , তাহলে ভোজসভার পরিবেশ নষ্ট হবে এবং এই মন্ত্রীর অপমান হবে , এই ধরনের পরিণতি আমি চাই না ।  

এই ঘটনার পর ছুচুয়ানওয়ান চেন রাজ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন । থানচিয়াও নামক একজন জেনারেল সাহসের সঙ্গে লড়াই করে বিরাট অবদান রাখেন । তার নেতৃত্বে ছুরাজ্যের সৈন্যরা চেনরাজ্যের রাজধানী পর্যন্ত ধাওয়া করে । আসলে থানচিয়াও সেই ভোজসভায় নেশাগ্রস্থ হয়ে রাজার উপপত্নী সুইচির হাত ধরেছিলেন , সুইচি রেগে গিয়ে তার টুপির ফিতা ছিড়ে দিলেন । রাজা অন্ধকারে উপস্থিত সকলের টুপির ফিতা ছিড়ে ফেলার প্রস্তাব করে তাকে রক্ষা করেন । রাজার এই দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশে জেনারেল থানচিয়াও রণক্ষেত্রে সাহসের সঙ্গে শত্রুদের হত্যা করেন । 

ছুচুয়ানওয়ানের ভুলকরা মন্ত্রীকে রক্ষা করার ঘটনা চীনের ইতিহাসে বহুল প্রচারিত হয় । চীনের একটি প্রবাদে এই ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করা হয় । এই প্রবাদে সবাইকে অন্যদের ভুল ক্ষমা করার উপদেশ দেয়া হয় ।