ওয়াংচাওচুন


       প্রাচীন চীনে মধ্য চীনে অবস্থান হান জাতির কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতির স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষ ঘটে । এই ধরনের সংঘর্ষ নিরসনের প্রধান উপায় হচ্ছে যুদ্ধ । সুন্দরী মেয়েকে সংখ্যালঘু জাতির সর্দারের সঙ্গে বিয়ে দিতে পাঠানোও সংখ্যালঘু জাতিগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাস্তাবায়নের একটি উপায় ।  

 হান রাজবংশের আমলে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সংখ্যালঘু সিউননু জাতির অভ্যন্তরে ক্ষমতার জন্য সংঘর্ষ ঘটে । সিউননু জাতি খন্ডবিখন্ড হয় । পাঁচজন সর্দার পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমন করে । এতে পাঁচজনে মধ্যে তিনজনই মারা যান । বাকী দুজন সর্দার এই বলে ভয় দেখান যে , যদি আরেকজন সর্দার হান জাতির কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে মিলিতভাবে নিজের বিরুদ্ধে আক্রমন করে , তাহলে নিজের সর্বনাশ হবে । তাই সিউননু জাতির হুহানসিয়ে নামক এক সর্দার হান রাজবংশের রাজধানী ছানআনে এসে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন , রাজা আন্তরিকভাবে তাকে স্বাগত জানান । তার ছানআন ত্যাগ করার সময় রাজা তাকে প্রচুর খাদ্যশস্য উপহার দেন এবং পথে নিরাপত্তার জন্য নিজের প্রহরী পাঠান । হান রাজবংশের সমর্থন পেয়ে হুহানসিয়ে আবার সিউননু জাতি একত্রিত করেন।  

হান রাজবংশের সঙ্গে বংশানুক্রমে বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য খৃষ্টপূর্ব তেত্রিশ সালে হুহানসিয়ে তৃতীয় বার ছানআনে আসেন । তিনি রাজার কাছে তার একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে করার অনুরোধ জানান । রাজা হুহানসিয়ের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন , কিন্তু তিনি নিজের মেয়েকে সংখ্যালঘু সিউননু জাতির সর্দারের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী নন । তাই রাজা রাজপ্রাসাদের পরিসেবার কাজে নিয়োজিত সহচরীদের জানান , তাদের মধ্যে যিনি সিউননুর সর্দারের সঙ্গে বিয়ে করতে রাজী হবে , রাজা তাকে রাজকুমারী হিসেবে গণ্য করবেন । 

রাজপ্রাসাদের পরিসেবার কাজকরা সহচরীরা সাধারণ পরিবার থেকে আসা সুন্দরী মেয়ে । তারা রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার দিন থেকেই নিজের স্বাধীনতা হারায় । যদিও তারা রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করতে চায় , তবে দূরদূরান্তের সংখ্যালঘু জাতির সর্দারের সঙ্গে বিয়ে করতে তারা চায় না ।  

তখনকার রাজপ্রাসাদের নিয়ম অনুসারে রাজপ্রাসাদের সহচরীরা রাজার সঙ্গে দেখা করতে পারে না । রাজপ্রাসাদের চিত্রকররা মেয়েদের ছবি একেঁ রাজাকে দেখতে দেন , রাজার বেছে নেয়া মেয়েরাই শুধু রাজার সঙ্গে দেখা করতে পারে । রাজার দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য মেয়েরা মাওইয়েনসো নামে একজন চিত্রকরকে খুশী করার জন্য তাকে অনেক উপহার দিত । তখন ওয়ানচাওচুন নামে একজন সহচরী ছিল । তিনি একজন সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী মেয়ে । যেমন কবিতা লিখতে পারেন , তেমনি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন ।তিনি চিত্রকরকে কোনো উপহার দেন না । তাই চিত্রকর মাওইয়েনসো খুব রাগ করেন । তিনি ইচ্ছা করে ওয়ানচাওচুনের ছবি বিশ্রীভাবে আকেঁন । তাই ওয়ানচাওচুন রাজার সঙ্গে দেখার কোনো সুযোগ পান না । 

নিজের সুখী জীবন আর হান রাজবংশ ও সিউননু জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বিবেচনা করে ওয়ানচাওচুন সিউননুর সর্দারের সঙ্গে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । রাজা এই খবর পেয়ে খুব খুশী এবং রাজধানী ছানআনে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সর্দার হুহানইয়ে ও ওয়াংচাওচুনের বিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন ।  

সিউননুর সর্দার হুহানসিয়ে পরীর মতো একটি স্ত্রী পেয়ে খুব খুশি । তিনি স্ত্রী ওয়ানচাওচুনের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে গিয়ে রাজাকে ধন্যবাদ জানান । রাজা এই প্রথমবার ওয়াংচাওচুনকে দেখে অবাক হলেন । এতো সুন্দর দাসী তিনি কখনো দেখেন নি । তিনি ওয়াংচাওচুনকে নিজের জন্য রাখতে চান , কিন্তু উপায় নেই । রাজা ওয়াংচাওচুনকে রাজকুমারী হিসেবে তাকে প্রচুর যৌতুক উপহার দেন । 

ওয়াংচাওচুন সুন্দর লাল জামা পরে একটি সাদা রঙের ঘোড়ার পিঠে বসে হান রাজবংশ ও সিউননুর লোকদের সহযোগে রাজধানী ছানআন ত্যাগ করেন। প্রথম দিকে ওয়াংচাওচুন সিউননু জাতির জীবন ও রীতিনীতি সম্বন্ধে অভ্যস্ত নন , কিন্তু তিনি অসুবিধা দূর করার চেষ্টা করেন এবং সিউননু জাতির লোকদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেন । 

ওয়াংচাওচুন সেখানে তার বাকী জীবন কাটান । তিনি সেখানে হান জাতির সংস্কৃতি প্রচার করেন । তার ছেলেমেয়েও তার মতো হান জাতি ও সিউননু জাতির মৈত্রী সম্পর্ক প্রসারের প্রয়াস করেন । বর্তমানে চীনের অন্তমঙ্গলিয়ার হুহেহাওটে শহরের উপকন্ঠে ওয়াংচাওচুনের সমাধিস্থল আছে । প্রাচীনকালের সিউননু জাতির জনগণ হান জাতির এই মৈত্রী দূতের স্মৃতির জন্য এই সমাধিস্থল তৈরি করেন । চীনের ইতিহাসে ওয়াংচাওচুনের কাহিনী বিখ্যাত । এই কাহিনী সম্পর্কিত কবিতা, অপেরা ও উপন্যাস প্রচুর।