ছেনসেন ও উকুয়ানের অভ্যুথান


       ছেনসেন ও উকুয়ান চীনের কৃষক অভ্যুথানের দুজন বিখ্যাত নেতা । তাদের পরিচালনায় ছিংরাজবংশের শেষ দিকে ( খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী ) চীনের ইতিহাসের প্রথম বিরাটাকার কৃষক অভ্যুথান ঘটে ।  

 খৃষ্টপূর্ব ২১০ সালে ছিংরাজবংশের প্রথম রাজা—ছিংসিহুয়ানের মৃত্যু হয় , তার কনিষ্ঠ ছেলে হুহাই রাজা হন । তিনিই ছিংরাজবংশের দ্বিতিয় রাজা ছিংআরসি ।  

ছিংআরসি এক নিষ্ঠুর ও জড়বুদ্ধি রাজা । তার শাসনাধীনে জনসাধারণের জীবনকষ্টকর , দন্ড আইন কঠোর , তারা ক্ষুধা ও মৃত্যুর সম্মুখীন হন । 

খৃষ্টপূর্ব ২০৯ সালে ছিংআরশি হুয়াইহো নদী অববাহিকা অঞ্চলের নয় শ’ গরীব কৃষককে ইয়ুইয়ান ( আজকের পেইচিং শহরের উপকন্ঠের মিইউন ) রক্ষার আদেশ জারি করেন ।  

গরীব কৃষক ছেনসেন ও উকুয়াং এই নয়শজন কৃষক রক্ষী দলের নেতা । তারা যখন ছি জেলার তাচে মহকুমায় পৌছান , ( আজকের আন হুই প্রদেশের সু জেলা ) প্রবল বৃষ্টিতে আটকে পড়েন । ছিং রাজবংশের আইন অনুসারে তারা যদি সময়মত ইয়ুইয়ান পৌছতে না পারেন , তাহলে তাদের সবাইকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে । 

কৃষকদের সঙ্গে দুজন রাজকীয় অফিসার ছিল । এই দুজন রাজকীয় অফিসার তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে । তাই ছেনসেন ও উকুয়ান এই দুজন অফিসারকে হত্যা করে কৃষকদের বলেন , প্রবল বৃষ্টিতে আমরা নির্দিষ্ট সময় ইয়ুইয়ান পৌছতে পারবো না , আইন অনুসারে সরকার আমাদের সবাইকে হত্যা করবে । যদি তারা আমাদের হত্যা না করে , আমরা সীমান্ত অঞ্চল রক্ষার লড়াইয়ে আমাদের মধ্যে বেশীর ভাগ লোকের মৃত্যু হবে । যদি আমাদের মরতেই হয় , তাহলে মৃত্যুর আগে একটি বড় কাজ করাই ভালো । তার প্রেরনায় নয় শ’ কৃষক ছেনসেন ও উকুয়ানকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে এক কৃষক অভ্যুথান বাহিনী গঠন করেন । তারা নিষ্ঠুর শাসনের বিরোধিতার শ্লোগান তুলে চীনের ইতিহাসের প্রথম কৃষক অভ্যুথান শুরু করেন । 

নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য ছেনসেন ও উকুয়ান প্রতি রাতে তাদের থাকার জায়গার আশেপাশের মন্দিরে স্থানীয় অধিবাসীদের অভ্যুথানে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান । কৃষক অভ্যুথান বাহিনী তাচে মহকুমা ও ছি জেলা দখলের পর আরো পাঁচ-ছয়টি জেলা দখল করেন । ছেনসেন ও উকুয়ানের নেতৃত্বাধীন অভ্যুথান বাহিনী ছেন জেলা দখলের পর ‘ চান ছু ’ নামে একটি প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে। ছেনসেন এই প্রশাসনের প্রধান । এটা চীনের ইতিহাসে প্রথম কৃষক বিপ্লবী প্রশাসন ।  

অভ্যুথান বাহিনী তিন দিক থেকে ছিং রাজবংশের বিরুদ্ধে আক্রমন করে। তখণ তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল কয়েক লক্ষ , গাড়ী কয়েক হাজার । 

অভ্যুথান বাহিনীর একটি দল চৌউনের নেতৃত্বে পশ্চিত চীনের সিতি পৌছে ,(আজকের সানসি প্রদেশের লিনথুন ) এই নগর ছিং রাজবংশের রাজধানী সিয়েনইয়ানের খুব কাছে । রাজা ছিংআরসি অভ্যুথান বাহিনী রাজধানীর কাছে পৌছার খবর পেয়ে ভয় পেয়ে অফিসার চানহানকে লিসানে তার সমাধীস্থল নির্মানরত কয়েক লক্ষ বন্দী নিয়ে অভ্যুথান বাহিনী প্রতিরোধের আদেশ দেন । এর সঙ্গে সঙ্গে রাজা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তিন লক্ষ সৈন্যকে অভ্যুথান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার আদেশ জারী করেন। চৌওনের নেতৃত্বাধীন কৃষক বাহিনী বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন । কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে পরাজিত হয়ে হানইউকুয়ান নামে একটি জায়গা থেকে প্রত্যাহার করে ছাওইয়ানে থেকে (আজকের হোনান প্রদেশের লিনপাও ) অন্য বাহিনীর সাহায্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে । 

উছেনের নেতৃত্বাধীন কৃষক বাহিনীর অন্য একটি দল চাওরাজ্যের পুরনো রাজধানী হানতান দখল করে । কৃষক বাহিনীতে অনুপ্রবেশ করা অভিজাত শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী চানআর ও ছেনইউর উস্কানিতে উছেন নিজেকে চাওরাজ্যের রাজা ঘোষনা করেন । কৃষক বাহিনীর প্রধান ছেনসেন সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার রাজার পদ স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন এবং তাকে চৌউয়েনকে সাহায্য করার আদেশ দেন । কিন্তু চানআর ও ছেনইয়ু ছেনসেনের আদেশ মানে না । তারা ছাওইয়ানে সাহায্যের জন্য অপেক্ষামান চৌউয়েনকে সাহায্য করতে যায়নি , বরং অভ্যুথান থেকে বেরিয়ে নিজেকে রাজা বলে ঘোষনা করেন । তাদের দুজনের দৃষ্টান্ত দেখে আগের ছয়টি রাজ্যের অভিজাত শক্তি পর পর অভ্যুথান থেকে বেরিয়ে যায় । এটা ছেনসেন ও উকুয়ানের নেতৃত্বাধীন কৃষক অভ্যুথান বাহিনীর শক্তি অনেক দুর্বল করে তুলে । চৌউয়েনের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ছাওইয়ানে সাহায্যের জন্য তিন মাস অপেক্ষা করে , কিন্তু সাহায্য পায় নি । পরিশেষে বিজয়ের আশা না দেখে চৌউয়েন আত্মহত্যা করেন । কিছু দিন পর কৃষক বাহিনীর অন্যতম নেতা উকুয়াং তার একজন অফিসারের হাতে নিহত হন । উকুয়াংয়ের মৃত্যুর পর অভ্যুথান বাহিনীর মধ্যে ফাটল ধরে । খৃষ্টপূর্ব ২০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ছিং রাজবংশের রাজকীয় বাহিনী চাওহানের নেতৃত্বে অভ্যুথান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন করে । ছেনসেন ও তার বাহিনী বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন , কিন্তু জয় লাভ করতে পারে নি , ছেনসেন তার গাড়ীওয়ালা চুয়াচিয়ার হাতে নিহত হন।  

লুইছেন নামে ছেনসেনের একজন অফিসার সংগ্রামে অটল থাকেন । এই বাহিনী পরে সিয়ানইউ ও লিউপানের নেতৃত্বাধীন অভ্যুথান বাহিনীর সঙ্গে মিলে অব্যাহতভাবে ছিং রাজ্যের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে । খৃষ্টপূর্ব ২০৬ সালে ছিং রাজবংশ কৃষক অভ্যুথান বাহিনীর মোক্ষম আঘাতে পতন হয় ।