প্রাচীন চিকিত্সাবিদ হুয়াথুও


       একজন লোক অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যান , আশা করেন ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেয়ে অসুখ ও গায়ের ব্যথা সেরে উঠবেন । চীনে যখন একজন রোগী দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত হয়েও আরোগ্যের আশা দেখেন না , তখন তিনি বলবেন , হুয়াথুও বেঁচে থাকলে আমাকে বাচাঁবেন । এই হুয়া থুও চীনের দু হাজার বছর আগের একজন চিকিত্সাবিদ , তিনি প্রায় সব রোগীর অসুখ দূর করতে পারতেন বলে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেন । 

 হুয়াথুও পূর্ব চীনের আনহুই প্রদেশের লোক । তার জন্ম তারিখ ইতিহাসের পুথিপত্রে লেখা নেই । খৃষ্টীয় ২০৮ সালে তখনকার শাসক তাকে হত্যা করেন । পুথিপত্রে বলা হয়েছে , শত বছর বয়সেও হুয়াথুওয়ের শরীর ভালো ছিলো । তিনি একজন লোক-চিকিত্সাবিদ , আশেপাশের অধিবাসিদের অসুখ দূর করতে পেরে তিনি আনন্দবোধ করতেন । তিনি লাভ ও খ্যাতির জন্য কাজ করেন নি , তাই বেশ কয়েকবার সরকারী কর্মকর্তা হওয়ার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেন । তখনকার শাসক ছাও ছাওয়ের মাথা ব্যথা ও মাথা ঘোরার রোগে ভুগতেন । তিনি হুয়া থুওকে তার জন্য চিকিত্সা করতে অনুরোধ করেন । হুয়া থুও গিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই ছাও ছাওয়ের বহু বছরের অসুখ দূর করেন । ছাও ছাও হুয়া থুওকে তার ব্যক্তিগত ডাক্তার হতে বাধ্য করেন । কিছুদিন পর হুয়া থুও স্ত্রীর অসুখের অজুহাতে ছুটি নিয়ে বাড়ী ফিরে গিয়ে আর ছাওছাওয়ের কাছে ফিরে যেতে চান না। ছাওছাও বার বার তাকে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেন । কিন্তু হুয়াথুও ফিরে না যাওয়ার জেদ ধরেন । কোনো উপায় না দেখে ছাওছাও হুয়াথুওকে জেলে পাঠানোর আদেশ দিলেন এবং জেলখানায় হুয়াথুওকে হত্যা করেন । 

  হুয়াথুও একজন ভালো ডাক্তার , তিনি রোগীদের নানা ধরনের অসুখ সারাতে পারতেন । যেমন সংক্রামক রোগ , স্ত্রীরোগ , শিশুর রোগ , শ্বাসনিশ্বাসের রোগ আর পরজীবীকীট রোগ ও চর্ম রোগ ইত্যাদি রোগের সব চিকিত্সা করতে পারতেন । বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের আগে গোটা শরীরের অনুভূতি বিলোপ করা আর রোগীদের অস্ত্রোপচার ক্ষেত্রে তিনি সুনিপুণ । হুয়াথুও প্রাচীন চীনের একজন জনপ্রিয় চিকিত্সাবিদ । তার সাফল্য দু হাজার বছর আগে চীনের চিকিত্সা বিদ্যার সাফল্যের একটি অংশ বলা যায় । পৃথিবীতে হুয়াথুও সর্বপ্রথম গোটা শরীরের অনুভূতি বিলোপের ব্যবস্থা করেন । তার আবিষ্কৃত অনুভুতি- বিলোপ ওষুধ অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর ব্যথা ও কষ্ট কমিয়ে দেয় । এই অনুভূতি-বিলোপ ওষুধের কল্যানেই হুয়াথুও সুষ্ঠুভাবে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করতে পারতেন । 

  হুয়াথুও নানা ধরনের অস্ত্রোপচার করতে পারদর্শী । একদিন তিনি ২০ বছর বয়সের একটি মেয়েকে অস্ত্রোপচার করেন । মেয়েটির বাঁ পায়ের হাঁটুতে একটি ফোড়া সাত -আট বছরেও সারে না । মেয়েটি শুধু চুলকানি অনুভব করেন , কিন্তু ব্যথা লাগে না । হুয়াথুও এই মেয়ের ফোড়ায় অস্ত্রোপচার করে ফোড়া থেকে সাপের মতো একটি জিনিস বের করেন এবং ক্ষতস্থানে কিছু ওষুধ দেন । এক সপ্তাহ পর মেয়েটি পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করে । মেয়ে ও তার পরিবার- পরিজন এতে মুগ্ধ হন । আধুনিককালের ডাক্তাররা মনে করেন , আসলে মেয়েটির হাটুর হাড়ের মজ্জার প্রদাহ হয়েছে । হুয়াথুও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগীর ফোড়া থেকে সাপের মতো একটি জিনিস বের করেন , এই জিনিস আসলে রোগীর মজ্জার প্রদাহ থেকে সৃষ্ট নষ্ট হাড়ের টুকরা । আরেকবার হুয়াথুও একজন বৃদ্ধার চিকিত্সা করেন । পরীক্ষার পর হুয়াথুও রোগীর পরিবার-পরিজনকে বলেন , তার এই রোগ পুরনো রোগ , অস্ত্রোপচার করতে হবে , তবে অস্ত্রোপচারের পর রোগী বড় জোর দশ বছর বাচঁতে পারবেন । কিন্তু যদি অস্ত্রোপচার না করি , রোগীর আয়ুও কমবে না ,তাই আমার মতে অস্ত্রোপচার না করাই ভালো । কিন্তু রোগী অসুখের কষ্ট আর সহ্য করতে চান না , হুয়াথুও তার জন্য অস্ত্রোপচার করলেন , রোগীর কষ্ট কমেছে , কিন্তু দশ বছর হতে না হতেই রোগীর মৃত্যু হলো । 

রোগ নির্ণয় ক্ষেত্রে হুয়াথুও অভিজ্ঞ। তিনি রোগীর মুখের রং , মানসিক অবস্থা ও রোগীর লক্ষণ অনুসারে রোগ নির্ণয় করতেন । একবার একটি রেস্তোঁরায় কয়েকজন লোক মদ খাচ্ছেন , তাদের মধ্যে ইয়েনসিন নামক একজন লোকের অবস্থা দেখে হুয়াথুও তাকে মদ খাওয়া বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেন । ওই লোক বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থেকে পড়েন , বাড়ি ফেরার অল্পক্ষণ পরই মারা যান । আরেক বার ছেনদেন নামক একজন রোগী হুয়াথুওয়ের কাছে যান । হুয়াথুও দেখেছেন এই রোগীর মুখ লাল। রোগী বলেন তার খাওয়ার রুচি নেই এবং মেজাজ খারাপ । হুয়াথুও পরীক্ষার পর তাকে বলেন , তার পেটে কীট আছে। হুয়াথুওয়ের দেয়া ওষুধ খেয়ে এই রোগীর পেট থেকে প্রচুর পরজীবী-কীট বের হয় । একদিন রাজকীয় সরকারের একজন অফিসার হুয়াথুওয়ের কাছে গিয়ে বলেন তিনি অনেক দিন ধরে অসুস্থ বোধ করছেন । হুয়াথুও তার বলা লক্ষণ বিবেচনা করে মনে করেন কোনো কারণে ভীষণ রাগ করার পর এই অফিসার সুস্থ হয়ে যাবেন । তাই তিনি এই অফিসারকে তিরষ্কার করে একটি চিঠি লিখেন , হুয়া থুও-র এই চিঠি পড়ে ওই লোকের ভীষণ রাগ হলো , তিনি হুয়াথুওকে হত্যার জন্য লোক পাঠান , কিন্তু হুয়াথুওকে পায় নি , প্রচন্ড ক্ষোভে এই অফিসার কালো রক্ত বমি করেন , কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কালো রক্ত বমির পর ওই অফিসার দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন ।  

সঠিক রোগ নির্ণয় চিকিত্সার কার্যকারীতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগীরা হুয়াথুওকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একটি প্রধান কারণ হলো হুয়াথুও রোগীর লক্ষণ বিশ্লেষন করে ওষুধ দেন । একবার দুজন রোগী তাকে একই লক্ষণ বলেন , দুজনেরই জ্বর ও মাথা ব্যথা । কিন্তু হুয়াথুও তাদের দুজনকে দুই ধরনের ওষুদ দেন । পাশের লোকেরা হুয়াথুওকে তার কারণ ব্যাখ্যার অনুরোধ করেন । হুয়াথুও বলেন , এই দুজন রোগীর লক্ষণ একই হলেও দুজনের অসুস্থ হওয়ার কারণ ভিন্ন , তাদের একজনের ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়েছে ,আরেকজন বেশি গরম জাতীয় খাবার খেয়ে জ্বর হয়েছে । তাই আমি তাদের ভিন্ন জাতীয় ওষুধ দিলাম । এই দুইজন রোগী হুয়াথুওয়ের দেয়া ওষুধ খেয়ে অল্প দিনের মধ্যেই সুস্থ হন । আধুনিককালে লোকেরা শারীরিক ব্যায়াম করে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন । দু হাজার বছর আগে হুয়াথুও ব্যায়াম করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের প্রস্তাব করেন। তার সৃষ্ট ‘ উছিনসি ’ নামে ব্যায়াম হলো বাঘ , হরিণ , ভল্লুক , বানর ও পাখি এই পাঁচ ধরনের জন্তুর আচরণ অনুকরণ করা। এই ব্যায়ামের কল্যানে অধিবাসীদের শারিরীক শক্তি ও রোগ প্রতিরোধের শক্তি বেড়েছে । হুয়াথুওয়ের অনেক ছাত্র ছিল। তার ছাত্রদের মধ্যে তিনজনের খ্যাতি সবচেয়ে বেশি , তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের চিকিত্সা ও ওষুধ বিদ্যার প্রসারে অবদান রেখেছেন । হুয়াথুওয়ের মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানীয় জনগণ চীনের অনেক জায়গায় ‘ হুয়াচু ’ মন্দির নির্মান করেন ।