চীনের ঐতিহ্যিক চিকিত্সার সুদীর্ঘকালের ইতিহাস আছে । ইতিহাসে ওষুধবিদ লি শি চেনের খ্যাতি সবচেয়ে বেশি । ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে চীনের মিং রাজবংশের সময় লি শি চেন ‘ বেন ছাও কান মু ’ নামে এক ওষুদ সম্পর্কিত রচনা তৈরি করেন । এই বই চীনের ঐতিহ্যিক চিকিত্সার ইতিহাসের একটি বিখ্যাত বই ।
লি শি চেনের জন্ম ১৫১৮ সালে
, মৃত্যু ১৫৯৩ সালে । মধ্য
চীনে হু পেই প্রদেশের ছি মেনে
তার জন্ম । ছি মেনে প্রচুর
ভেষজ ওষুধ চাষ করা হয় । লি
শি চেনের বাবা একজন ডাক্তার
। কাজেই লি শি চেন ছোট বেলা
থেকেই বাবার সঙ্গে পাহাড়ে উঠে
ওষুধ সংগ্রহ করতেন এবং বাসায়
ফিরে বাবার সঙ্গে ওষুধ তৈরি
করতেন । কিন্তু সেই আমলে ডাক্তারদের
সামাজিক অবস্থান নীচু ছিল ।
তার বাবা আশা করেছিলেন লি শি
চে পড়াশুনা করে সরকারী কর্মচারী
হবেন ।
১৫৩১ সালে ১৪ বছর বয়সের লি
শি চেন রাজকীয় পরীক্ষার মাধ্যমে
‘ সিউ ছাই ’ নামক নিম্ন স্তরের
পন্ডিত হন । এরপর তিনি উচ্চতর
পন্ডিত ‘ চু রেন ’ হওয়ার জন্য
তিনবার রাজকীয় পরীক্ষায় অংশ
নেন , কিন্তু তিনবারই পরীক্ষা
ফেল করেন । লি শি চেন আর পরীক্ষায়
অংশ নেন নি । বাবার কাছ থেকে
চিকিত্সা বিদ্যা শিখতে শুরু
করেন । যোগ্য ডাক্তার হয়ে গরীব
অধিবাসীদের অসুখবিসুখ দূর করার
জন্য লি শি চে জেলে , শিকারী
, কাঠুরিয়া , কৃষক ও ওষুধ চাষকারীদের
বাসায় যান । তিনি তাদের কাছ
থেকে প্রচুর রোগ চিকিত্সার
পদ্ধতি সংগ্রহ করেন । তিনি
বার বার পরীক্ষা করেন এবং বিভিন্ন
ওষুধের ভূমিকা তুলনা করেন ।
১৫৫১ সালে লি শি চেন একজন নামকরা
ডাক্তার হন । একদিন রাজার ছেলে
গুরুতর অসুস্থ হলে লি শি চেনের
চিকিত্সায় দ্রুত আরোগ্য লাভ
করেন । রাজা খুব খুশি , তিনি
লি শি চেনকে রাজকীয় হাসপাতালে
কাজ করার সুপারিশ করেন।
তখনকার রাজা অন্ধ বিশ্বাসে
বিশ্বাসী । তিনি মনে করেন অমরত্বের
ওষুধ খেয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে
থাকতে পারবেন । রাজকীয় হাসপাতালের
অন্যান্য ডাক্তাররাও রাজার
প্রভাবে এই ধরনের ওষুধ খুঁজে
বের করার চেষ্টা করেন । লি
শি চেন রাজকীয় হাসপাতালের একঘেঁয়ে
জীবন পছন্দ করেন না । তিনি
সাধারণ অধিবাসীদের সাহায্য
করতে চান । তাই তিনি রাজকীয়
হাসপাতালের পদ ছেড়ে দিয়ে বাসায়
ফিরে যান । তিনি আশেপাশের অধিবাসীদের
চিকিত্সার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের
বই লেখার চেষ্টা করেন ।
রোগীদের চিকিত্সার সময় লি শি
চেন আবিষ্কার করেন , আগের ওষুধ
বই পুরোপুরি নির্ভরশীল নয় ,
কোনো কোনো জায়গায় কিছু অন্ধবিশ্বাস
ও ভুলও আছে। লি শি চেন মনে
করেন , এটা অধিবাসীর স্বাস্থ্য
ও জীবন বিপন্ন করা এক গুরুতর
ব্যাপার । কাজেই তিনি একটি
নতুন ওষুধ বই রচনার সিদ্ধান্ত
নেন । ১৫২২ সাল থেকে লি শি
চেন নতুন ওষুধ বই ‘বেন ছাও
কান মি ’ রচনার কাজ শুরু করেন
।
নতুন ওষুধ বই রচনার জন্য লি
শি চে আট শতাধিক চিকিত্সা রচনা
ও অন্যান্য বই পড়েন ।বই লেখার
সময় তিনি চিকিত্সা বই ও নিজের
বাস্তব অনুশীলনে সংগ্রহ করা
তথ্যের সমন্বয় করেন । রচনা
সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি নিজের
রচনা ওষুধ বই তিন-তিন বার পুঙ্খানুপুঙ্খ
পর্যালোচনা করেন ও সংশোধন করেন
। বই লেখার প্রক্রিয়ায় তার
ছেলে , নাতি ও তার ছাত্ররা
সাহায্য করেন । প্রায় ৩০ বছরের
কঠোর প্রচেষ্টায় লি শি চেন
তার ‘ বেন ছাও কান মু ’ নামক
বিখ্যাত রচনা সম্পন্ন করেন
।
‘ বেন ছাও কান মু ’-র মোট অক্ষর
সংখ্যা ১৯ লক্ষেরও বেশী । ৫০
খন্ডের এই মহত্ রচনায় ১৬ বিভাগের
৬০টি ধারায় বিভক্ত । এই রচনায়
১৮৯২ ধরনের ওষুধের আকার ও ভূমিকা
বর্ণনা করা হয় এবং ১১ হাজারটি
ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিপিবদ্ধ
করা হয় । তাছাড়া বিভিন্ন ভেষজ
ওষুধেরর আকার নির্ণয় করার জন্য
এই বইতে এক হাজারেরও বেশি ওষুধের
পাতা ও গাছের ছবি আছে । ‘ বেন
ছাও কান মু ’তে ওষুধকে বিভিন্ন
ভাগে ভাগ করা হয় । ইউরোপের
বিজ্ঞানীরা লি শি চেনের চেয়ে
দু শ’ বছর পর অর্থাত ১৭৪১ সালে
এই ধরনের ওষুধ ভাগ করার পদ্ধতি
পেশ করেন । তাছাড়া , লি শি
চেন তার রচিত ‘ বেন ছাও কান
মু ’তে আগের চিকিত্সা বই ও
ওষুধের ব্যবস্থাপত্রের ভুলগুলো
সংশোধন করেন এবং ওষুধ ও তার
ভূমিকা সংযোজন করেন । লি শি
চেন তার রচনায় আগের চিকিত্সা
বইগুলোতে প্রচারিত অন্ধবিশ্বাসের
সমালোচনা করেন ।লি শি চেনের
আমলে অনেকেই বিশ্বাস করেন মানুষ
অমরত্বের ওষুধ খেয়ে চিরকাল
বেঁচে থাকতে পারেন , তাই সবাই
এই ধরনের ওষুধ পাওয়ার চেষ্টা
করেন । লি শি চেন তার সরল বস্তুবাদী
তত্ব দিয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন
ধরনের অন্ধবিশ্বাস খন্ডন করেন।
লি শি চেন ত্রিশ বছর প্রচেষ্টা
চালিয়ে চীনের কয়েক হাজার বছরের
ওষুধ ব্যবহারের অভিজ্ঞতার সারসংকলন
করেন । তিনি ওষুধ বিজ্ঞানের
মহত রচনা ‘ বেন ছাও কান মু
’ লিখে প্রাচীন চীনের চিকিত্সা
বিজ্ঞানের প্রসারে অনন্যসাধারণ
অবদান রেখেছেন । তিনি প্রাচীন
চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত ওষুধ
তত্ববিদ । তার রচিত এই বই জাপানে
কয়েকবার ছাপানো হয় । ‘ বেন
ছাও কান মু ’ ইংরেজী , ফরাসী
, জার্মানী আর লাতিন ভাষায়
অনুদিত করা হয়েছে । সপ্তদশ
শতাব্দী থেকে ‘ বেন ছাও কান
মু ’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে
ছড়িয়ে পড়ে । আধুনিক যুগের ওষুধ
তত্ববিদরাও তার এই রচনা পড়েন
।
|