তাও মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা --- লাও তান


       লাও তানের আসল নাম লি আর । তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সবাই তাকে লাও চি বলেন । লাও চি বসন্ত - শরত যুগের ( খৃষ্টপূর্ব ৭৭০ ---খৃষ্টপূর্ব ৪৭৬ সাল ) শেষ দিকের ছু রাজ্যের লোক । প্রাচীন পুথিপত্র থেকে জানা গেছে , লাও চি এক উচ্চ গড়নের লোক , তার কান লম্বা , কলাপ চওড়া আর ঠোঁট পুরু । লাও তান চৌ রাজবংশের গ্রন্থাগারের প্রধান ছিলেন । লাও তান প্রচুর বই পড়েছেন বলে সবাই জানেন তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি । কনফুসিয়াস একদা লাও তানের কাছে গিয়ে তার কাছ থেকে চৌ রাজবংশের শিষ্টাচার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন । চৌ রাজবংশের শক্তি দিন দিন দুর্বল হচ্ছে দেখে লাও তান রাজধানী লো ইয়ান ত্যাগ করেন । পথে হান কু কুয়ান নামে এক জায়গা পার হওয়ার সময় লাও তান ‘ তাও তে চিন ’ নামক একটি বই লিখেন । বই লেখা শেষ করে তিনি একটি গরুর পিঠে বসে লো ইয়াং ত্যাগ করেন । তার পর আর লাও তানের সঠিক খবর পাওয়া যায় নি । কেউ বলেন লাও তান দু শ’ বছর পর্যন্ত জীবীত ছিলেন , কেউ বলেন , তিনি ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । জীবিতকালে লাও তান সব সময় নিষ্পাপ মন বজায় রাখার চেষ্টা করেন এবং কোনো অতিরিক্ত দাবী করতেন না , তাই তার দীর্ঘায়ু স্বাভাবিক ব্যাপার ।

 লাও তানের লেখা ‘ তাও তে চিন ’-য়ের আরেকটি নাম হলো ‘লাও চি ’ । এই রচনার মোট অক্ষর সংখ্যা পাঁচ হাজারের কিছু বেশি । ‘ লাও চি ’ চীনের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ । লাও তান একজন বস্তুবাদী চিন্তাবিদ । চীনে তিনি সর্বপ্রথম তাওকে দর্শনের আওতার অন্তর্ভুক্ত করেন। ‘তাও’-এর আসল অর্থ মানুষের হাটাঁহাটিঁর পথ । পৃথিবীতে নানা ধরনের পথ আছে । লাও তান প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও মানুষে-মানুষে সম্পর্ক বিবেচনা করে তাওকে নতুন অর্থ যোগান । লাও তানের মতে , ‘তাও’ হলো সবচেয়ে বাস্তব জিনিস , তাই তাও পৃথিবীর সব কিছুর উত্স ।  

লাও তান সরল পরিপ্রেক্ষিতের বিচারমূলক তত্ব দিয়ে ‘ তাও তে চিন ’ রচনা করেন । এটা লাও চির দার্শনিক চিন্তাধারার প্রধান অংশ । তিনি মনে করেন পৃথিবীর সব জিনিস বিছিন্ন নয় , বরং পরস্পর নির্ভর ও সম্পর্কিত ।  

লাও তান তার ‘ তাও তে চিন’-তে পৃথিবীর সব ব্যাপার পরিবর্তনের নিয়ম বর্ণনা করেন । তিনি মনে করেন , সুখ ও দুঃখ অপরিবর্তনীয় নয় । সুখ দুঃখে পরিণত হয় আর দুঃখ সুখে পরিণত হয় । দুঃখের ভিতরে সুখের উপাদান আছে আর সুখের ভিতরে দুঃখের সম্ভাবনা আছে । লাও তান আরও বলেন , একটি জিনিস বা ব্যাপার বেশী বা স্থায়ী হলে পরিবর্তন ঘটবে । একটি ছোট বীজ বাড়তে বাড়তে একটি বড় গাছ হবে , মাটি দিয়ে বড় মাচার তৈরি করা যায় । তিনি বলেন , অসুবিধা ও বাধাবিঘ্নকে ভয় না করে চেষ্টা করলেই অসুবিধা কাটিয়ে সাফল্যমন্ডিত হওয়া যায় ।  

লাও তান যুদ্ধের বিরোধিতা করেন । তিনি বলেন , যে সব জায়গায় সৈন্যবাহিনী মোতায়েন থাকে , সেইসব জায়গায় ফসল হবে না । বড় যুদ্ধের পর অবশ্যই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে । লাও তান শাসক শ্রেণীর সীমাহীন খাজনা ও কর আদায়ের ব্যবস্থার বিরোধীতা করেন । 

লাও তান তার স্বপ্নের সমাজের বর্ণনা করে বলেন , দেশটি ছোট , অধিবাসীর সংখ্যা কম । এই দেশে অস্ত্র থাকবে , কিন্তু কেউ ব্যবহার করবে না। এই দেশে নৌকা ও গাড়ি আছে , কিন্তু অধিবাসীরা পায়ে হাঁটতে পছন্দ করেন । অধিবাসীরা ভালো ভালো খাবার খান , সুন্দর সুন্দর জামা-পোশাক পরেন এবং আরামদায়ক বাড়ীতে থাকেন । এই দেশের প্রতিবেশি দেশ আছে , কিন্তু অধিবাসীরা প্রতিবেশি দেশের জনগণের সঙ্গে আদান-প্রদান করেন না । অধিবাসীরা সাদাসিদা জীবন যাপন করেন বলে এই দেশের কোনো লিখিত ভাষার প্রয়োজন নেই ।লাও তানের আদর্শ নিষ্ক্রিয় ও রক্ষণশীল । এতে বসন্ত-সরত যুগের বছরের পর বছর যুদ্ধের প্রতি লাও তানের ঘৃণা আর শান্তিপূর্ণ সমাজের প্রতি তার আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে ।  

চীনের দর্শনের ইতিহাসে লাও তানের দার্শনিক চিন্তাধারার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা পরবর্তীকালের অগ্রণী চিন্তাবিদ ও কাল্পনিক সমাজ সংষ্কারদের প্রতি প্রভাব বিস্তার করেছে ।