চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির কথা
বলতে গেলে চীনের ইতিহাসের একজন
বিখ্যাত ব্যক্তির কথা অবশ্যই
উল্লেখ করতে হবে , তিনি হলেন
কনফুসিয়াস । গত শতাব্দীর সওর
দশকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন পন্ডিত
মানব জাতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ
প্রভাব-বিস্তারকারী এক শ’ জন
বিখ্যাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ
করার সময় চীনের কনফুসিয়াসকে
পঞ্চম স্থান দিয়েছেন । তার
তৈরি পৃথিবীর এক শ’জন বিখ্যাত
ব্যক্তির নামের তালিকায় কনফুসিয়াসের
আগে শুধু যিশু ও শাকমুনি প্রমুখ
বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিরা রয়েছেন।
এ কথা বলা যায় ,প্রত্যেক চীনার
গায়ে কনফুসিয়াসের কম-বেশি প্রভাব
আছে ।
কনফুসিয়াস হলেন চীনের কনফুসিয়ান
তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা । দু
হাজার বছর ধরে চীনে কনফুসিয়ান
তত্বের প্রভাব শুধু রাজনীতি
ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে
নয় , চীনাদের চিন্তাধারা ও
আচার-আচরণেও আছে । কোনো কোনো
বিদেশী পন্ডিত কনফুসিয়ান তত্ত্বকে
চীনের ধর্মীয় চিন্তাধারা মনে
করেন। আসলে কনফুসিয়ান তত্ত্ব
প্রাচীন চীনের মতবাদগুলোর অন্যতম
মাত্র। এই তত্ব ধর্ম নয় , এক
ধরনের দার্শনিক চিন্তাধারা
। চীনে দু হাজার স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক
সমাজে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাকে
যথেষ্ঠ মর্যাদা দেয়া হয়। কনফুসিয়াসের
চিন্তাধারা শুধু চীনে বিরাট
প্রভাব বিস্তার করে নি , তার
প্রভাব কিছু এশিয় দেশে বিস্তৃত
হয়েছে । পৃথিবীর প্রায় সব দেশে
প্রবাসী চীনা আছে। কাজেই কনফুসিয়াসের
চিন্তাধারা চীন ও এশিয়ার সীমা
ছাড়িয়েছে ।
খৃষ্টপূর্ব ৫৫১ সালে কনফুসিয়াসের
জন্ম । খৃষ্টপূর্ব ৪৭৯ সালে
তার মৃত্যু হয় । তার জন্ম গ্রীসের
বিখ্যাত পন্ডিত আরিষ্টোটলের
চেয়ে শতাধিক বছর আগে। কনফুসিয়াসের
বয়স যখন তিন বছর , তার বাবা
মারা যান । তিনি মার সঙ্গে
এখানকার পূর্ব চীনের সাংতুং
প্রদেশে থাকতেন । কনফুসিয়াসের
আসল নাম খুন ছিউ , কনফুসিয়াস
হলো তার প্রতি সবার সম্মানসূচক
ডাক । প্রাচীন চীনে একজনকে
সম্মান প্রদর্শনের জন্য লোকেরা
তার পারিবারিক উপাধির পিছনে
চি যোগ করতেন । কনফুসিয়াসের
পারিবারিক উপাধি খুন , তাই
সবাই তাকে খোন চি ডাকেন ।
কনফুসিয়ান চীনের ইতিহাসের বসন্ত-শরত
যুগের লোক । এই সময়পর্বে আগের
একীভূত রাজ্য ভেঙ্গে অনেক ছোট
ছোট রাজ্যে পরিণত হয় । কনফুসিয়াস
তখনকার লু রাজ্যের লোক । সেই
আমলে লু রাজ্যের সংস্কৃতি সবচেয়ে
সমৃদ্ধ ।
কনফুসিয়াস একজন বিদ্বান ব্যক্তি
। তিনি সারা জীবনে কোনো বড়
সরকারী অফিসার হন নি । প্রাচীন
চীনে পড়াশুনার সুযোগ পাওয়া
শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানের
অধিকার ছিল । কিন্তু কনফুসিয়াস
এই ধরণের অধিকার ভেঙ্গে দেন
। তিনি ছাত্রদের সংগ্রহ করে
তাদের শিক্ষা দেন । যে কোনো
লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প
কিছু খাবার বা অন্য জিনিস জমা
দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে
পারতেন । কনফুসিয়াস নিজের ছাত্রদের
তার রাজনৈতিক মতবাদ ও নৈতিক
চিন্তাধারা প্রচার করেন । জানা
গেছে , কনফুসিয়াসের প্রায় তিন
হাজার ছাত্রের মধ্যে বেশ কয়েকজন
পরে বড় পন্ডিত হয়েছিলেন । তারা
কনফুসিয়াসের চিন্তাধারার উওরাধিকার
সূত্রে গ্রহণ করেছেন এবং তার
বিকাশ করেছেন ।
চীনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে
শাসক শ্রেণী কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাকে
সমর্থন করেন। তার কারণ জটিল
হলেও সংক্ষেপে বলতে গেলে কনফুসিয়াসের
কড়া শ্রেণীবিভাগ চিন্তা আর
রাজনৈতিক সংস্কারের চিন্তা
শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে
সংগতিপূর্ণ । তার এইসব চিন্তাধারা
রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
আর সমাজের বিকাশের অনুকুল ।
কনফুসিয়াস মনে করেন নিচু স্তরের
কর্মকর্তা-- উপর ওয়ালার নির্দেশ
লংঘন করা আর ছেলে বাবার কথা
অনুসারে কাজ না করা গুরুতর
অপরাধ । তার মতে , রাজাকে ভালো
করে দেশশাসন করতে হবে এবং সাধারণ
অধিবাসীকে রাজাকে মান্য করতে
হয় । একজন লোক একই সময় মন্ত্রী
,বাবা ও ছেলে হতে পারেন । তাকে
বিভিন্ন অবস্থায় শ্রেণীবিভাগ
ও পারিবারিক অবস্থান অনুসারে
নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে
। এইভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা
বজায় থাকবে ।
কনফুসিয়াসের মতবাদ সৃষ্টির
প্রথম দিকে শাসক শ্রেণী তা’
গ্রহণ করেনি। কিন্তু খৃষ্টপূর্ব
দ্বিতীয় শতাব্দীর সময় চীন একটি
একীভূত শক্তিশালী দেশে পরিণত
হয় । শাসক শ্রেণী মনে করে কনফুসিয়াসের
মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের
স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে অনুকুল
, তাই তার চিন্তাধারাকে রাষ্ট্রীয়
মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
‘ লুন ইয়ু ’ নামক একটি বইয়ে
কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা ও আচার-
আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে । এই
বইয়ে কনফুসিয়াসের বক্তব্য আর
তিনি ও তার শিষ্যদের কথাবার্তাও
লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । প্রাচীন
চীনে এই বই পাশ্চাত্য দেশের
বাইবেলের মতো পবিত্র ছিল ।
এই বই সবার পক্ষে প্রয়োজন।
একজন সাধারণ অধিবাসীকে এই বইয়ে
লেখা আচার আচরণ অনুসারে জীবনযাপন
করতে হয় । একজন সরকারী অফিসারের
পক্ষে এই বই পড়া আরো প্রয়োজনীয়
। এই বই ভালো করে পড়েই শুধু
যোগ্য সরকারী কর্মকর্তা হতে
পারেন । চীনের ইতিহাসে একটি
কথা আছে , কনফুসিয়াসের মতবাদ
সম্বলিত ‘ লুন ইয়ু’ নামক বইয়ের
অর্ধেক তত্বই দেশশাসনে যথেষ্ঠ
।
আসলে ‘ লুন ইয়ু ’একটি একঘেয়ে তাত্ত্বিক বই নয় । তার আলোচ্য বিষয় সমৃদ্ধ, ভাষা প্রানবন্ত । পাঠকরা এই থেকে কনফুসিয়াসের বুদ্ধি স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন । এই বইয়ে বই পড়া , সংগীত , পর্যটন ও বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশাসহ নানা বিষয়ে কনফুসিয়াসের মন্তব্য আছে । ‘ লুন ইয়ু ’ তে কনফুসিয়াসের চি কোন নামক এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করেন , সৈন্যবাহিনী , খাদ্যশস্য ও জনগন –এই তিনটের মধ্যে যদি একটি বাদ দিতে হয় , তাহলে আপনি কোনটি বেছে নেবেন ? কনফুসিয়াস কোনো দ্বিধা না করে উত্তর দিলেন , সৈন্যবাহিনীকে বাদ দেবো ।
কনফুসিয়াসের মতবাদ প্রাচীনকালের মতবাদ হলেও অনেক বিষয় আজ পর্যন্ত কাজে লাগে । ‘ লুন ইয়ুতে ’ কনফুসিয়াসের অনেক উক্তি চীনারা এখনও ব্যবহার করছেন , যেমন কনফুসিয়াস বলেছিলেনঃ তিনজনের মধ্যে অবশ্যই আমার শিক্ষক আছেন । কনফুসিয়ানের এই কথার অর্থ হলো প্রত্যেকজনের গুন আছে , কাজেই পরস্পরকে শিখতে হবে ।
|