মেনং চি (মেনসিয়াস)


       মেনং চি চীনের যুদ্ধরত রাজ্যসমুহ যুগের ( খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী ) মহান চিন্তাবিদ । তিনি ছিলেন প্রাচীন চীনের প্রধান মতবাদ—কনফুসিয়ান মতবাদের অন্যতম প্রতিনিধি ।  

 মেনং চির নাম খে , খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে চৌ রাজ্য অর্থাত আজকের সানতুং প্রদেশের চৌছেন শহরে তার জন্ম । প্রাচীন পুথিপত্রে বলা হয়েছে , মেনং চি তখনকার লু রাজ্যের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান । সেই আমলে সমাজে নানা ধরনের মতবাদ দেখা দেয় । মেন চি কনফুসিয়ান মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা – কনফুসিয়াসের চিন্তাধারার উত্তরাধিকার সুত্রে বিকাশ করেন এবং তার ভিত্তিতে এক পরিপূর্ণ মতবাদ পেশ করেন । এই মতবাদ চীনের ইতিহাসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে । মেনং চিকে কনফুসিয়াসের পর প্রাচীন চীনের দ্বিতীয় মহাজ্ঞানী বলে অভিহিত করা হয় । 

মেনং চি কনফুসিয়াসের নৈতিক উত্কর্ষ দেখিয়ে শাসন করার চিন্তাধারা আরো পরিপূর্ণ করেন । তার এই চিন্তাধারা তার মতবাদের প্রধান অংশ । নৈতিক উত্কর্ষ দেখিয়ে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রেণী দ্বন্দ্ব শিথিল করা আর সামন্ত শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা ।  

মেনং চি মনে করেন শাসক শ্রেণী ও শোসিতদের শ্রেণীগত অবস্থান একেবারে ভিন্ন। তার ধারনা , মনীষীদের শ্রমিক-কৃষকদের শাসন করা উচিত। তিনি রাজা থেকে সাধারণ অধিবাসী পর্যন্ত রাজ্যের সমস্ত ব্যক্তিকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করে এক শ্রেণীবিভাগের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন । এর পাশাপাশি মেনং চি আবার শাসক ও শাসিতদের সম্পর্ককে পিতা-মাতার সঙ্গে ছেলেমেয়ের সম্পর্কের মতো উপমা করেন। তিনি মনে করেন , শাসকশ্রেণীকে পিতামাতার মতো জনসাধারণের দুঃখকষ্টে যত্ন নিতে হয় । জনসাধারণকে শাসক শ্রেণীকে নিজের পিতামাতা হিসেবে মনে করে তাদের সেবা করা উচিত ।  

মেনং চি যুদ্ধরত রাজ্যসমুহ সময়পর্বের বাস্তব অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে দেশশাসনের একটি বিখ্যাত অভিমত পেশ করেন । তার ধারনা , জনসারাধণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । দেশের গুরুত্ব জনসাধারণের চেয়ে কম , রাজার গুরুত্ব সবচেয়ে কম । তিনি মনে করেন , দেশের সমৃদ্ধি ও শক্তি বাড়াতে জনসাধারণের প্রতি সঠিক ব্যবহার করা জরুরী । মেনং চি জনসাধারণের সমর্থনকে গুরুত্ব দেন। তিনি তার রচনাগুলোতে বিপুল ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে শাসক শ্রেণীর জনসাধারণের সমর্থন পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করেন । 

মেনং চি নৈতিকতা ও রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত করে জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে নিজের নৈতিক উত্কর্ষ বাড়ানো দেশশাসনের একটি মূল বিষয় ।  

তিনি মনে করেন , নৈতিক উত্কর্ষের মধ্যে চার ধরনের গুণ অর্থাত করুণা , ন্যায়বিচার , শিষ্টাচার ও বিজ্ঞতার মধ্যে করুণা ও সুবিচার বেশী গুরুত্বপূর্ণ । যদি সমাজের প্রত্যেকজন করুনাময় মনোভাব পোষণ করে ন্যায়বিচার অনুসারে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক পরিচালনা করেন , তাহলে সমাজের স্থিতিশীলতা ও একীভূত রাজ্য নিশ্চিত হবে ।  

নিজের মতবাদ ব্যাখ্যা করার জন্য মেন চি পেশ করেন, পৃথিবীর সব মানুষের স্বভাবে দয়া আছে । তিনি মনে করেন , যদিও সমাজের বিভিন্ন মহলের লোক নানা ধরনের পদে কাজ করেন বা শারিরীক পরিশ্রম করেন , কিন্তু তাদের জন্মগত স্বভাব একই ।  

যদিও মেনং চি’র মতবাদ চীনের বিভিন্ন রাজবংশের রাজনীতি , সংস্কৃতি , নৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে , তবে তখনকার শাসকরা মেনং চি’র মতবাদকে গুরুত্ব দেন নি ।  

মেনং চি একজন পন্ডিত হিসেবে তখনকার বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে তার করুনাময় প্রশাসন ব্যবস্থা প্রচার করেন । তিনি লিয়ান রাজ্য , ছি রাজ্য , সুং রাজ্য , থেন রাজ্য ও লু রাজ্যে গিয়েছিলেন । কিন্তু তখন এইসব রাজ্যের শাসকরা নিজের শক্তি জোরদার করার চেষ্টা করছিলো । তারা যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধরত রাজ্যগুলোর একায়ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন । তারা মেনং চি’র করুণাময় শাসনের মতবাদকে পন্ডিতি উক্তি বলে মনে করেন । তাই কেউ তার মতবাদ গ্রহণ করেন নি । মেনং চি শাসকশ্রেণী ও ধনী ব্যক্তিদের তুচ্ছ করতেন এবং যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত সাধারণ অধিবাসীদের উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন । তাই তিনি ন্যায়পরায়ন ও সাহসী মনোভাব পোষন করে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে নিজের মতবাদ প্রচার করেন । 

তাঁর মতবাদ শাসকরা গ্রহণ করেনি বলে মেনং চি শিক্ষকতা করতে শুরু করেন এবং তার ছাত্রদের সঙ্গে ‘ মেনং চি ’ নামে একটি বই লিখেন । তার এই বইতে মেন চির মতবাদ আর অন্য মতবাদের লোকদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করার কথা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । কন্ফুসিয়াসের পর কন্ফুসিয়ান তত্বের অনুসারী হিসেবে মেনং চি এই তত্বের উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছেন এবং তার বিকাশ করেন। তার লেখা এই বইতে যেমন আছে নিজের মতবাদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা , তেমনি আছে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তার তীব্র সমালোচনা । আজ পর্যন্ত লোকেরা তার এই রচনা থেকে মেন চি’র এই মহত চিন্তাবিদের ন্যায়পরায়নতা ও দেশপ্রেম মনোভাব অনুভব করতে পারেন । তাই যুগ যুগ ধরে চীনারা মেনং চি’র এই রচনা পড়েন এবং তাকে কনফুসিয়ান তত্ত্বের শাস্ত্র বলে মনে করেন ।