হান রাজবংশের প্রথম রাজা লিউ পান


       লিউপান হলেন পশ্চিম হান রাজবংশের ( খৃষ্টপূর্ব ২০৬ সাল থেকে খৃষ্টীয় ২২০ সাল পর্যন্ত ) প্রথম রাজা । তিনি চীনের ইতিহাসে দুজন গরীব পরিবারের রাজার মধ্যে অন্যতম ।  
এক কৃষক পরিবারে লিউপানের জন্ম । কিন্তু কৃষি কাজে তার উত্সাহ ছিল না । তিনি ছিং রাজবংশের স্থানীয় সরকারের এক নিম্ন স্তরের কর্মকর্তা ছিলেন । তিনি একজন উদার ব্যক্তি । জেলখানার বন্দী ছেড়ে দিয়ে তিনি পালিয়ে যান । খৃষ্টপূর্ব ২০৯ সালে লিউপান তার জন্মস্থানে গ্রামবাসীদের জড়ো দিয়ে ছেনসেন ও উকুয়ানের কৃষক অভ্যুথানে অংশ নেন । পরে তিনি অভ্যুথানের বাহিনী নিয়ে ছিং রাজবংশের রাজধানী সিয়েন ইয়ান প্রবেশ করে ছিন রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে । লিউপান ছিং রাজবংশের রাজধানী সিয়েন ইয়ানে কঠোর আইন ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন আইন ব্যবস্থা স্থাপন করেন । তার ধারণায় শুধু নর হত্যাকারী অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া উচিত , অন্য লোককে আহত করা অপরাধী ও চোরকে কারাগারে আটক করা উচিত । তার এইসব নতুন আইনবিধি জনগণের সমর্থন পায়। 

এরপর লিউপান ছিং-বিরোধী আরেকজন কমান্ডার সিয়ানইয়ুর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে চার বছর যুদ্ধ করেন । খৃষ্টপূর্ব ২০২ সালে লিউপানের তিন লক্ষ সৈন্য সিয়ানইয়ুর বাহিনীকে ঘেরাও করে । সিয়ানইয়ু আত্মহত্যা করেন । খৃষ্টপূর্ব ২০২ সালে লিউপান সানতুংয়ে হান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন ।  

লিউপানের একটি বড় গুন হলো তিনি যোগ্য কর্মী নিয়োগ করতে জানতেন । কাজেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি বিপদ থেকে রেহাই পেতেন । হান রাজবংশ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে সৈন্যবাহিনী থেকে প্রায়ই সৈন্য পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতো । একবার হানসিন নামক এক যুব কমান্ডার পালিয়ে গেল । সিয়াওহে নামে লিউ পানের একজন মন্ত্রী সময় নষ্ট না করে লিউ পানকে না জানিয়ে হানসিনকে পিছু ধাওয়া করতে যান । হানসিনকে পাওয়ার পর তিনি লিউপানের কাছে হানসিংকে গুরু দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন । তখন হানসিনের কোনো খ্যাতি ছিল না । কিন্তু লিউপান সিয়াওহের সুপারিশ গ্রহন করে হানসিনকে সৈন্যবাহিনীর একজন সিনিয়ার কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করেন । পরে হানসিন রাজা লিউপানের জন্য অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন ।  

চীনের ইতিহাসে ‘ হোনমেনইয়েন’ অর্থাত হোনমেন নামক এক জায়গায় লিউপান ও সিয়ানইয়ুর একটি ভোজসভার কাহিনী সবাই জানেন । সেই সময় সিয়ানইয়ুর সামরিক শক্তি লিউপানের চেয়ে বেশি , সিয়ানইয়ু লিউ পানকে নিশ্চিহৃ করে নিজে রাজা হতে চান । এই খবর পেয়ে লিউপান ও তার সহকারী চাংলিয়ান সিয়ানইয়ুর সেনানিবাসে গিয়ে পরাজয় স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন । সিয়ানইয়ুর একজন সহকারী ফানচেন সিয়ানইয়ুকে এই সুযোগে লিউপানকে হত্যা করার প্রস্তাব করেন । ভোজানুষ্ঠানে সিয়ানইয়ুর সিয়ানচুয়ান নামক এক কমান্ডার অসি চর্চা পরিবেশনের সুযোগে লিউপানকে হত্যা করার চেষ্টা করেন । এই বিপদজনক মুহুর্তে চাংলিয়ান লিউপাংয়ের দেহরক্ষী ফানহুইকে লিউপাংকে রক্ষা করতে বলেন । ফানহুইয়ের সাহায্যে লিউপান বাথরুমে যাওয়ার অজুহাতে ছোট পথ দিয়ে নিজের সেনানিবাসে ফিরে যান । লিউপান নিরাপদে চলে গেছেন দেখে তার সহকারী চাংলিয়ান সিয়ানইয়ুর কাছে গিয়ে উপহার দিয়ে বিদায় জানান এবং তাকে জানান লিউপান ইতিমধ্যে চলে গেছেন । এটি চীনের ইতিহাসের বিখ্যাত ঘটনা -- হোনমেন ইয়েন । এই ঘটনার পর লিউপান তার শক্তি কেন্দ্রীভূত করে সিয়ানইয়ুকে পরাজিত করে পশ্চিম হান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন । 

পশ্চিম হান রাজবংশের প্রথম রাজা হওয়ার পর লিউপান উত্পাদন বাড়ানোর অনেক ব্যবস্থা নেন । একটানা বহু বছর স্থায়ী যুদ্ধের দরুন দেশের লোকসংখ্যা অনেক কমে যায় । লিউপান কারাগারের সব বন্দী ও দাসকে মুক্তি দেন , সৈন্যদের বাড়ী ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং অবদান অনুসারে তাদের বসতবাড়ী ও জমি দেন । কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য লিউপান লিউ উপাধির নয়জন ভূস্বামীকে নিয়োগ করেন এবং অন্য উপাধির ভূস্বামী ও তাদের পরিবারপরিজনসহ মোট এক লক্ষ লোককে দূরদূরান্তে নির্বাসন দেন ।  

ছিং রাজবংশের পতনের পর চীনের উত্তরাঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতির প্রশাসন দক্ষিণাঞ্চলে হান রাজবংশের সীমান্ত এলাকায় আক্রমন করে । খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালে লিউপান স্বয়ং সৈন্য নিয়ে সংখ্যালঘু জাতির আক্রমন প্রতিরোধ করতে যান । তিনি সংখ্যালঘু জাতির সৈন্যদের তিন লক্ষ ঘোড়সওয়ার সৈন্যের ঘেরাও অভিযানে সাত দিন সাত রাত ছিলেন । মুক্তি পাওয়ার পর সংখ্যালঘু জাতির সঙ্গে সম্পর্ক প্রশমনের জন্য লিউপান তাদের সঙ্গে সম্প্রীতির নীতি কার্যকরী করতে বাধ্য হন এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে শুরু করেন । 

লিউপান একজন সমরবিদ । তিনি পন্ডিতদের হীন মনে করতো । রাজা হওয়ার পর তিনি মনে করেন তিনি যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজা হন , কাজেই বই পড়া ও সংস্কৃতির কোনো প্রয়োজন নেই । চিয়াই নামে তার একজন মন্ত্রী তাকে বলেছেন , আপনি যুদ্ধ করে রাজা হয়েছেন সত্য , কিন্তু আপনি যুদ্ধ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন ? মন্ত্রীর এই কথা শুনে লিউপান চিয়াইকে ছিং রাজবংশ পতনের কারণ বিশ্লেষণ করে বই লেখার নির্দেশ দেন । রাজা হওয়ার বার বছর পর এক অভ্যুথান দমনে লিউপান আহত হন এবং কিছু দিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।