হোন মেন ভোজানুষ্ঠানের কাহিনী


        প্রাচীন চীনে ইতিহাসে অনেক দুর্বল শক্তির শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করা আর বুদ্ধি খাটিয়ে বিজয় অজর্নের সামরিক কাহিনীও আছে । 

  খৃষ্টপূর্ব ২২১ সালে চীনের ইতিহাসের প্রথম একত্রিত সামন্ততান্ত্রিক রাজ্য ---ছিন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় । ছিন রাজ্যের শাসকদের দুরাচার ও কঠোর শাসনের দরুন জনগণের জীবন অত্যন্ত কষ্টের ছিলো , গণ অভ্যুত্থানও ঘন ঘন ঘটে । অভ্যুত্থানকারী শক্তিগুলোর মধ্যে দুটি বাহিনী দ্রুত শক্তিশালী হয় । এই দুটি অভ্যুত্থান- বাহিনীর দুজন নেতা ছিলেন ছু তিরকমান্ডার সিয়ান ইয়ু আর ছিন রাজ্যের একজন নিম্ন পর্যায়ের কর্মী লিউ পান ।  

  সিয়ান ইয়ু এক অহংকারী ব্যক্তি , অন্যদের পরামর্শ শুনেন না , কিন্তু তিনি যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গেলড়াই করেন । লিউ পান চালাক হলেও যোগ্য ব্যক্তিদের বেছে নিতে পারেন । ছিন রাজবংশের প্রতিরোধ যুদ্ধে সিয়ান ইয়ু ও লিউ পান পরস্পরকে সাহায্য করেন , তাদের দুজনের শক্তি বেড়েছিল । তারা দুজন এই বলে একমত হয়েছেন যেদুজনের মধ্যে যিনি প্রথমে ছিন রাজবংশের রাজধানী সিয়েন ইয়ানে প্রবেশ করবেন , তিনিই রাজা হবেন ।  

   খৃষ্টপূর্ব ২০৭ সালে সিয়ান ইয়ু চু লুতে ছিন রাজবংশের প্রধান শক্তিকে পরাজিত করেন । কিন্তু সেই সময় লিউ পান ইতিমধ্যে সৈন্য নিয়ে ছিন রাজবংশের রাজধানী সিয়েন ইয়ান দখল করেছেন । লিউ পান তার একজন উপদেষ্টার পরামর্শ অনুসারে সিয়েন ইয়ান নগরে প্রবেশ করেন নি , কিন্তু রাজপ্রাসাদ ও গুদামগুলো বন্ধ করে দেন , সৈন্যদের সিয়েন ইয়ানের কাছাকাছি জায়গায় সমাবেশ করার ব্যবস্থা করেন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সান্তনা দেন ।অধিবাসীরা লিউ পানের এই ব্যবহার পছন্দ করেন , তারা আশা করেন লিউ পান নতুন রাজা হবেন । 

  লিউ পান তার আগে রাজধানী সিয়েন ইয়ান দখলের খবর পেয়ে সিয়ান ইয়ু রাগ করলেন । তিনি চার লক্ষ সৈন্য নিয়েসিয়েন ইয়ানের নিকটবর্তী হোন মেনে ( আজকের সান সি প্রদেশের লিন থোন শহর ) সমাবেশ করে সিয়েন ইয়ান দখলের প্রস্তুতি নেন । সিয়ান ইয়ুর উপদেষ্টাফান চেন সিয়ান ইয়ুকে লিউ পানের শক্তি নিশ্চিহৃ করার পরামর্শ দেন । তিনি বললেন , লিউ পান একজন লোভী ও চরিত্রহীন ব্যক্তি , সিয়েন ইয়ান দখলের পর লিউ পান রাজপ্রাসাদের কোনো জিনিস নেন নি এবং সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন নি , এতে প্রমাণিত হয়েছে যে লিউ পান একটি বড় ষড়যন্ত্রএটেঁছে । তার ষড়যন্ত্র হাসিলের আগেই আমাদের তাকে হত্যা করা উচিত ।  

  লিউ পান সিয়ান ইয়ুরসৈন্য সমাবেশের খবর পেয়ে উপদেষ্টা চান লিয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করেন । চান লিয়ান মনে করেন , লিউ পানের সৈন্য সংখ্যা মাত্র এক লক্ষ , সিয়ান ইয়ুর চার লক্ষ সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করা যায় না।সিয়ান ইয়ুর সঙ্গে লিউ পানের সহযোগিতার সদ্দিচ্ছা জানাতে চান লিয়ান নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু , সিয়ান ইয়ুর চাচা সিয়ান পোকে পাঠালেন । তার পর লিউ পানউপদেষ্টা চান লিয়ান ও কমান্ডার ফান হুইকে সঙ্গে নিয়ে হোন মেনে গিয়ে সিয়ান ইয়ুকে বললেন ,তিনি রাজধানী সিয়েন ইয়ান রক্ষার জন্য দখল করেছেন , রাজা হওয়া নয় , সিয়ান ইয়ুই রাজা হবেন । সিয়ান ইয়ু লিউ পানের কথা বিশ্বাস করলেন এবং হোন মেনে একটি ভোজে তাকে আপ্যায়ন করেন । ভোজানুষ্ঠানে উপদেষ্টা ফান চেন সিয়ান ইয়ুর পাশে বসেন ,তিনি বেশ কয়েকবার সিয়ান ইয়ুকে লিউ পানকে হত্যার ইংগীত দেন , কিন্তু সিয়ান ইয়ু দেখেও না দেখার ভান করেন । এই অবস্থায় ফান চেন কমান্ডার সিয়ান চুয়ানকেতলোয়ার চালিয়েলিউ পানকে হত্যা করার ইংগিত দেন । সিয়ান ইয়ুর চাচা সিয়ান পোও সিয়ান চুয়ানের সঙ্গে তলোয়ার চালনা করেন এবং নিজের শরীর দিয়ে লিউ পানকে রক্ষা করেন , তাই সিয়ান চুয়ান লিউ পানকে হত্যার সুযোগ পান না । এই জরুরী মুহুর্তে লিউ পানের উপদেষ্টা ভোজানুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাইরে অপেক্ষারত কমান্ডার ফান হুইকে ডাকলেন । ফান হুই হাতে তলোয়ারয়ার ও ধনুক নিয়ে ভোজানুষ্ঠান কক্ষে প্রবেশ করে সিয়ান ইয়ুকে অভিযোগ করে বললেন , লিউ পান সিয়েন ইয়ান নগর দখল করেছেন , কিন্তু আপনার জন্য অপেক্ষা করার জন্য নগরে প্রবেশ করেন নি । লিউ পান এত বড় অবদান রেখেছেন , কিন্তু তিনি কোনো পুরস্কার পান নি , আপনি আপনার উপদেষ্টার কথা শুনে নিজের ভাইকে হত্যা করতে চাচ্ছেন । এই কথা শুনে সিয়ান ইয়ু লজ্জ্বা বোধ করেন । এই সুযোগে লিউ পান বাথরুম যাওয়ার অজুহাতে ভোজানুষ্ঠান ত্যাগ করে নিজের সেনা নিবাসে ফিরে গেলেন । লিউ পান নিরাপদে পালিয়েছেন দেখে সিয়ান ইয়ুর উপদেষ্টা ফান হুই রাগ করে বললেন , সিয়ান ইয়ুরচরিত্রের দরুণ তিনি কোনো বড় কাজ করতে পারবেন না , ভবিষ্যতে লিউ পানই চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করবেন । 

   এটাই ইতিহাসের বিখ্যাত ‘ হোন মেই ভোজানুষ্ঠান ’ । সিয়ান ইয়ুমনে করেন নিজের সৈন্য শক্তি লিউ পানের কয়েক গুন , তাই লিউ পানের কথা বিশ্বাস করলেন এবং লিউ পানের ভোজানুষ্ঠানত্যাগকে বাধা দেন নি । পরে সিয়ান ইয়ু রাজা হিসেবে নিজেকে ‘ সিছুপাওয়ান ’ ডাকেন , তিনি লিউ পানকে এক জনবিরল অঞ্চলের এক স্থানীয় প্রশাসক নিয়োগ করেন । কিছু দিন পর সিয়ান ইয়ু সৈন্য নিয়েযুদ্ধ করতে বাইরে যাওয়ার সুযোগে লিউ পান সিয়েন ইয়ান দখল করলেন । তখন থেকে লিউ পান ও সিয়ান ইয়ুর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো , ‘ ছু হান লড়াই ’ বলে পরিচিত এই যুদ্ধ চার বছর স্থায়ীছিলো । সিয়ান ইয়ুর সৈন্য বেশী বলে তার বাহিনী বহু বার লিউ পানের বাহিনীকে পরাজিত করেছিল । কিন্তু সিয়ান ইয়ু এক খারাপ মেজাজের ব্যক্তি , তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী আগুন জ্বালায় এবং অনেক অধিবাসীকে হত্যা করে । স্থানীয় অধিবাসীরা সিয়ানইয়ু ও তার বাহিনীকে ঘৃণা করেন । লিউ পান স্থানীয় অধিবাসীদের সমর্থন পাওয়া আর যোগ্য ব্যক্তিদেরকাজে লাগানোর চেষ্টা করেন । ফলে লিউ পানের শক্তি ক্রমেই বাড়ে এবং শেষে বিজয় অর্জন করেন। 

  খৃষ্টপূর্ব ২০২ সালে লিউ পানের বাহিনী হাই সিয়ায় ( আজকের আন হুই প্রদেশের লিন পি শহর ) সিয়ান ইয়ুর বাহিনীকে ঘেরাও করে । তার রক্ষীদের সাহায্যে সিয়ান ইয়ু ঘেরাও থেকেমুক্তি পান । কিন্তু লিউ পানের বাহিনী তার পিছু ধাওয়া করে , সিয়ান ইয়ু আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন । লিউ পান চীনের ইতিহাসের দ্বিতীয় একত্রিত সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশ--- হান রাজবংশের প্রথম রাজা হলেন ।