ফেই সুই যুদ্ধের কাহিনী


       খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর সময় চীনের একত্রিত কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙ্গে গিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ চীনে দুটি প্রশাসন সৃষ্টি হয় । দক্ষিণ চীনের প্রশাসন হলো হান জাতির পূর্ব চিন রাজবংশ । পূর্ব চিন রাজবংশের রাজধানী চিয়েন খান ( আজকের নান চিং শহর ) , ইয়াংসি নদী বরাবর অঞ্চল পূর্ব চিন রাজবংশের শাসনাধীনে ছিলো । উত্তর চীনের হুয়াং হো নদী বরাবর অঞ্চলে ছিয়েন ছিন নামে একটি রাজ্যছিলো , তার রাজধানী ছান আন , ছান আন নগর আজকের সি আন শহর ।

  ছিয়েন ছিনের রাজা ফু চিয়েন একজন দক্ষ শাসক ছিলেন । তিনি হান জাতির উপদেষ্টাদের উচ্চ পদে নিয়োগ করে শাসন ব্যবস্থা সংস্কার করেন , অভিজাত দুরাচারদের উপর আঘাত হানেন । এর সঙ্গে সঙ্গে ফু চিয়েন জল প্রকল্প নিমার্ণ করে কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার নীতি কার্যকরী করেন এবং সামরিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেন । তিনি পূর্ব চিন নিশ্চিহৃ করে দেশের পুনরেকীকরণ বাস্তবায়ন করতে চান । 

  খৃষ্টীয় ৩৮৩ সালে ফু চিয়েন রাজ্যের বিভিন্ন জাতির অধিবাসীদের মধ্যে সৈন্য জোগাড় করেপূর্ব চিনয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিলেন । সেই সময় তার সৈন্য সংখ্যা আট লক্ষ ৭০ হাজার ছিলো । গোয়েন্দাদের সংগ্রহ করা তথ্য অনুসারে পূর্ব চিন রাজ্যের সৈন্য সংখ্যা মাত্র এক লক্ষের কিছু বেশী । তাই ফু চিয়েন ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন , আমার সৈন্যদের ঘোড়ার চাবুক নদীতে ফেলে দিলে নদীর স্রোত বন্ধ হয়ে যাবে , এতোবেশী সৈন্য কি পূর্ব চিন নিশ্চিহৃ করতে পারবে না ? 

   ছিয়েন ছিনের বাহিনীআসার খবর পেয়ে পূর্ব চিনয়ের রাজা কমান্ডার সিয়ে সি ও সিয়ে সুয়েনকে ৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে শত্রু র আক্রমণ প্রতিরোধের আদেশ দিলেন । এই সময় ছিয়েন ছিনের অগ্রনী বাহিনী ইতিমধ্যে পূর্ব চিং রাজ্যের নিকটবর্তীলো হো নদী পর্যন্ত পৌঁছেছে । তারা হুয়াই নদীর যাতায়াত বন্ধ করে দেয় , পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদজনক। কমান্ডার সিয়ে সি ও সিয়ে সুয়েনের পাঠানো পূর্ব চিন রাজ্যের পাঁচ হাজারঘোড়সওয়ার সৈন্য পাঠিয়ে লো হো নদীর শত্রু সৈন্যের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বিজয় অর্জন করে , এতে পূর্ব চিং রাজ্যের বাহিনী বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত হয় । তারা স্থল ও নৌ পথে ফেই সুই নদীর ( হুয়াই নদীর শাখা নদি , আজকের আন হুই প্রদেশের মধ্য অঞ্চলে অবস্থিত ) পূর্ব তীরে সমবেত হয় ।

  অগ্রনী বাহিনীর পরাজয়ের খবর পেয়ে ফু চিয়েন রণক্ষেত্রে গেলেন । তিনি নগরের মঞ্চে উঠে ফেই সুই নদীর পূর্ব তীরের চিং বাহিনী পর্যবেক্ষণ করেন । তিনি দেখেছেন , পূর্ব তীরে প্রচুরতাবু ও পতাকা , সেনানিবাস থেকে ঢাক-ঢোলের শব্দও শোনা যায় । এই দৃশ্য দেখে ফুচিয়েন অবাক হলেন। তিনি আবার দূরের পাকোন পাহাড়ের দিকে তাকান । অনমনস্কে তিনি পাকোন পাহাড়ের গাছগুলো শত্রুসৈন্যের পতাকা ও অস্ত্র মনে করেন । প্রচুর শত্রুসৈন্য নদীর পূর্ব তীরে সমাবেশ করা হয়েছে দেখে ফু চিয়েন ভয় পেলেন। তিনি তার সহকারীকে বললেন , চিং রাজ্যেরসৈন্য এতো বেশী , কে বলেছে তাদের শক্তি দুর্বল ? 

  পূর্ব চিন বাহিনীর কমান্ডার সিয়ে সি ও সিয়ে সুয়েন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করা উচিত । কারণ ছিয়েন ছিনের বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেশি হলেও বিভিন্ন জাতির অধিবাসীদের মধ্য থেকে জোর করে জোগাড় করা হয়েছে বলে সৈন্যদের মধ্যে ঐক্য কম । তা ছাড়াদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সৈন্য ও ঘোড়া ক্লান্ত। কমান্ডার সিয়ে সি ও সিয়ে সুয়েন ছিয়েন ছিনের কমান্ডার ফু চিয়েনের কাছে একটি চিঠি পাঠালেন । চিঠিতে তারা ফু চিয়েনকে তার সৈন্য পিছনে সরানোর দাবী জানালেন , যাতে পূর্ব চিং রাজ্যের সৈন্য ফেই সুই নদী অতিক্রম করে ছিয়েন ছিনের বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে পারে । ফু চিয়েন এই চিঠি পেয়ে ভাবলেন , পূর্ব চিন বাহিনীর নদী পার হওয়ার সময় তার বাহিনী আক্রমণ চালালে ছিয়েন ছিনের বিজয় নিশ্চিত হবে । তাই তিনি তার বাহিনীকে পিছনে সরানোর আদেশ দিলেন । ছিয়েন ছিনের বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেশী , তাদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ অধিবাসী , যুদ্ধ করতে চায় না । তাই পিছনের সৈন্যরা পিছু হটার আদেশ শুনে মনে করে সম্মুখ ফ্রন্টে তাদের বাহিনী পরাজিত হয়েছে , তাই পিছনের সৈন্য পালাতে শুরু করে । ছিয়েন ছিনের বাহিনীতে বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে পূর্ব চিং বাহিনী দ্রুত ফেই সুই নদী অতিক্রম করেফু চিয়েনের সৈন্যের উপর আঘাত হানতে শুরু করে । ছিয়েন ছিন বাহিনীতে কোনো কোনো সৈন্য চিত্কার করে , ছিন বাহিনী পরাজিতহলো , ছিন বাহিনী পরাজিত হলো । এই চিত্কার শুনে ছিয়েন ছিনের কয়েক লক্ষ সৈন্য আরো বিশৃঙ্খল হয়ে উঠে । তারা পরস্পরকে হত্যা করে , এতে প্রচুর সৈন্য নিহত হয় , ফুচিয়েনগায়ে তীর বিদ্ধ হয়ে আহত হন ।ফু চিয়েন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে পালাতে শুরু করেন , পূর্ব চিং বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করেন । দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ছিয়েন ছিনের বাহিনী অত্যন্ত ক্লান্ত, তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে চায় । ঠিক এই সময় তারা বাতাসের উ –উ শব্দ ও সারসের ডাক শুনে মনে করে চিং বাহিনী আবার এসেছে , তাই তারা বিশ্রাম করার সাহস না পেয়ে আবার পালাতে শুরু করে । ছিয়েন ছিনের বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর আর পুনর্গঠিত হতে পারে নি । দু বছর পর ছিয়েন ছিনের পতন হয়।  

  ফেই সুই যুদ্ধে পূর্ব চিং রাজ্যের আশি হাজার সৈন্য ছিয়েন ছিনের আট লক্ষ ৭০ হাজার সৈন্য পরাজিত করে বিজয় অজর্ন করেছিলো , তাই এই যুদ্ধ চীনের ইতিহাসে দুবর্ল বাহিনী শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করার একটি বিখ্যাত দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে । তা ছাড়া ফেই সুই যুদ্ধের পর ‘ চাবুক ফেলে নদীর স্রোত বন্ধ করা ’ ও ‘ গাছ –ঘাসকে সৈন্য হিসেবে ভয় করা ’ আর ‘ বাতাস ও সারসের ডাকও শত্রুমনে করা ’ ইত্যাদি কাহিনী থেকে তৈরী প্রবাদ সৃষ্টিহয়েছে ।