চীনের একটি প্রবাদে বলা হয়েছে ,ছাগলের নেতৃত্বাধীন একদল সিংহ , সিংহের নেতৃত্বাধীন একদল ছাগলকে পরাজিত করতে পারে না । এই প্রবাদেযুদ্ধে সেনানায়কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রতিফলিত হয়েছে ।
খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনে হান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয় । হান রাজকীয় সরকার পশ্চিমাংশের হুন জাতির অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয়ের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল , দু পক্ষের মধ্যে কোনো বিরাটাকার সংঘর্ষ ঘটে নি । পরে হুন জাতির সর্দাররা অন্য লোকের প্ররোচনায়হান রাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিন্ন করেন । খৃষ্টপূর্ব ১৫৮ সালে হুন জাতি হান রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে আক্রমণ করে , তারা স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা করে এবং তাদের সম্পত্তি কেড়ে নেয় । হান রাজবংশের সীমান্ত অঞ্চলে সংকেত মঞ্চগুলোর সৈন্যরা আগুন জ্বালিয়ে রাজকীয় সরকারকে এ খবর দেয় । সীমান্ত অঞ্চল থেকে অগ্নিসংকেতরাজধানী ছান আন পর্যন্ত পৌঁছে । হুন’র আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য রাজা তিনজন কমান্ডারকে তিনদল সৈন্য নিয়ে সীমান্ত অঞ্চলে পাঠালেন । তা ছাড়া রাজা তিনজন কমান্ডারকে সৈন্য নিয়ে রাজধানী ছান আনের নিকটবর্তী এলাকায় মোতায়েনের আদেশ দিলেন । কমান্ডার লিউ লির সৈন্য পা সানে , সুই লির সৈন্য চি মেনে আর চৌ ইয়াফুর সৈন্য সিলিউতে মোতায়েন করা হয় ।
একবার রাজা হান ওয়েন তি স্বয়ং এই তিনটি জায়গার সৈন্যদের দেখতে গেলেন । কমান্ডার লিউ লি ও তার সৈন্যরা রাজাকে দেখেবিরাট সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । রাজা ও তার রক্ষীরা সেনানিবাসে কোনো বাধা পান নি । যাওয়ার সময় লিউ লি রাজার জন্য এক বিরাট বিদায় সংবধর্না অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । চেমেনেও কমান্ডার সুই লি রাজার জন্য একই রকম সংবধর্নাআয়োজন করেন। শেষে রাজা চৌ ইয়া ফুর সেনানিবাসে গেলেন । সেনানিবাসের রক্ষীরা দূর থেকে একদল লোক আসছে দেখে কমান্ডার চৌ ইয়া ফুকে খবর দিলেন । চৌ ইয়া ফু তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির আদেশ দিলেন । রাজার অগ্রনী দল সেনানিবাসের গেটে পৌছলে চৌ ইয়া ফুর সৈন্যরা তাদের বাধা দেয় । রাজার প্রহরীরা বলে , মাননীয় রাজা এখনই আসছেন । প্রহরীরা স্পষ্টভাষায় উত্তর দিলেনঃ সেনানিবাসে আমরা শুধু কমান্ডারের আদেশ মানি ।আমরা কমান্ডারের আদেশ পাই নি , তাই আপনাদের আমরা ঢুকতে দিতে পারি না । এই সময় রাজার গাড়ী সেনানিবাসের গেটের সামনে এসে পড়ল । প্রহরীরা রাজার গাড়ীকেও বাধা দিল । কোনো উপায় না দেখে রাজা হান ওয়েন তি প্রহরীকে রাজার প্রমাণপত্র দেখিয়ে চৌ ইয়া ফুকে তার আগমনের খবর জানানোর আদেশ দিলেন । চৌ ইয়া ফু এই খবর পেয়ে সেনানিবাসের গেট খোলার আদেশ দিলেন । সেনানিবাসে প্রবেশের পর চৌ ইয়া ফুর সৈন্যরা রাজার প্রহরীদের জানালো ,নিয়ম অনুসারেসেনানিবাসে ঘোড়া দৌড় দিতে পারে না । রাজার প্রহরীরা এই কথা শুনে খুব রাগ করে , কিন্তু রাজা হান ওয়েন তি ঘোড়াগুলোকে ধীর গতিতে চলার আদেশ দিলেন ।
সেনানিবাসের সদর দপ্তরে গিয়ে চৌ ইয়া বর্ম পরে হাতে অস্ত্র নিয়ে রাজাকে স্বাগত জানান । চৌ ইয়া ফু রাজাকে প্রণাম করে বললেন , আমি বর্ম পরেছি বলে আমি নতজানু হয়ে আপনাকে স্বাগত জানাতে পারছি না , আজ সামরিক নিয়মে আপনাকে সংবধর্না জানাচ্ছি , এর জন্য আপনার ক্ষমা চাই । চৌ ইয়া ফুর কথা শুনে রাজা রাগ করেন নি , তিনি চৌ ইয়া ফুর সংবধর্নার উত্তর দিয়ে সেনানিবাসের সৈন্যদের প্রতি তার সমবেদনা জানালেন । চৌ ইয়া ফুর সেনানিবাস ত্যাগ করে রাজধানী যাওয়ার পথে রাজার প্রহরীরা অভিযোগ করেন যে চৌ ইয়া ফু রাজাকে যথেষ্ট সম্মান জানান নি । কিন্তু রাজা চৌ ইয়া ফুর প্রশংসা করে বললেন , চৌ ইয়া ফুই একজন সত্যিকার কমান্ডার । পা সান ও চে মেনের বাহিনীতে প্রহরা ব্যবস্থা শিথিল , শত্রুর আক্রমণের সামনেসংগ্রামী শক্তি কম এবং সহজেই শত্রুর হাতে বন্দী হবে । চৌ ইয়া ফুরবাহিনীতে কঠোর শৃঙ্খলা আছে , শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি ভালো । রাজা মনে করেন চৌ ইয়া ফু একজন যোগ্য সামরিক কমান্ডার ।
পরের বছর রাজা হান ওয়েন তি রোগাক্রান্ত হন , মৃত্যুর আগে তিনি রাজপুত্রকে বললেন , পরে রাজ্যে কোনো অভ্যুত্থান ঘটলে চৌ ইয়া ফুকে অভ্যুত্থান দমনের দায়িত্ব দেবে , তিনি নিশ্চয়ই এই গুরু দায়িত্ব বহন করতে পারবেন । হান ওয়েন তির মৃত্যুর পর তার ছেলে লিউ ছি রাজা হলেন , ইতিহাসে তিনি হান চিং তিবলে পরিচিত । হান চিং তিরবয়স কম বলেলিউ পির নেতৃত্বাধীন সাতজন স্থানীয় প্রশাসক রাজকীয় ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার জন্য সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল । রাজা হান চিং তি চৌ ইয়া ফুকে অভ্যুত্থান দমনের আদেশ দেন । সাতজন স্থানীয় প্রশাসকের মিলিত আক্রমণের সামনে চৌ ইয়া ফু আত্মরক্ষামূলক রণকৌশল অবলম্বন করেন । রাজা হান চিং তি বেশ কয়েকবার তাকে বিদ্রোহী সৈন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন , কিন্তু চৌ ইয়া ফু গ্রহন তা করেন না । তিনি জানেন বিদ্রোহী বাহিনী শক্তিশালী হলেও বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না । ঠিক যেন চৌ ইয়া ফু অনুমান করেছেন , চৌ ইয়া ফুর আত্মরক্ষামূলক রণকৌশলের সামনে বিদ্রোহী বাহিনী অস্থির হয়ে উঠে । বার বার আক্রমণ চালালেও চৌ ইয়া ফু পাল্টা হামলা করেন না ।
শেষে বিদ্রোহী বাহিনী সরে যেতে বাধ্য হয় । এই সময় চৌ ইয়া ফু শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করতে বিপুল সৈন্য পাঠালেন । এতে বিদ্রোহী বাহিনীতে ব্যাপকহতাহত হয় । অভ্যুত্থানের সর্দার লিউ পি পালানোর পথে নিজ বাহিনীর কমান্ডারের হাতে নিহত হন , অন্য কয়েকজন স্থানীয় প্রশাসক পরাজয় নিশ্চিত দেখে আত্মহত্যা করেন ।
সাতজন স্থানীয় প্রশাসকের অভ্যুত্থান দমন করার পর পশ্চিম হান রাজ্য আরো শক্তিশালী হয় ,চীনের ইতিহাসেপশ্চিম হান রাজবংশের আমল একটি সার্বিক সমৃদ্ধির সময়পর্ব ।
|