প্রাচীন চীনের পূর্ব হান রাজবংশের আমলে রাজধানী লোইয়াং ও আশেপাশের জায়গায় প্রায়ই ভূমিকম্প হতো । ঐতিহাসিক পুথিপত্রে বলা হয়েছে ,খৃষ্টীয় ৮৯ সাল থেকে ১৪০ সাল পর্যন্ত ৫১ বছরে এই অঞ্চলে মোট ৩৩বার ভুমিকম্প হয়েছিলো । এর মধ্যে ১১৯ সালেদুই বার প্রচন্ড ভুকম্প আশেপাশের দশ-বারোটি জেলায় দু বার প্রচন্ড ভূমিকম্পহয় । প্রচন্ড ভূমিকম্পে বিপুল সংখ্যক বসতবাড়ী ধসে পড়ে , অনেক অধিবাসী ও গবাদী পশু হতাহত হয় । স্থানীয় অধিবাসীরা ভূমিকম্পকে ভয় করেন , রাজা মনে করেন এটা ভগবানের শাস্তি । তাই রাজা অধিবাসীদের কর বাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নিলেন । তিনি আদায় করা কর দিয়ে ভগবানের ক্ষমা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন । পূর্ব হান রাজবংশের আমলে চান হেন নামে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন । তিনি জ্যোতিবির্দ্যা , গনিত বিদ্যা ও পঞ্জিকা ব্যবস্থা গবেষণা করেন এবং ভূমিকম্প বিষয়ক অন্ধবিশ্বাস মানতেন না । তিনি মনে করেন ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার । এই প্রাকৃতিক ব্যাপার সম্বন্ধে অধিবাসীদের জ্ঞান কম বলে সবাই ভয় করেন । এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চান হেন তার ভূমিকম্প সম্পর্কিত গবেষণা আরো জোরদার করলেন ।
চান হেন মনোযোগ সহকারে প্রতিবার ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ করেন এবংভূমিকম্পের বিস্তারিত বিবরণ তৈরী করেন । তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে ভূমিকম্প ঘটার কারণ বিশ্লেষণ করেন । বহু বছর পরীক্ষার পর ১৩২ সালে চান হেন চীনের তথা পৃথিবীর প্রথম ভূমিকম্প পূর্বাভাস যন্ত্র তৈরী করেন , তিনি তার এই যন্ত্রকে ভূকম্প যন্ত্র নাম দিলেন ।
চান হেনের তৈরী এই ভূকম্প যন্ত্র ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী হয় । এই যন্ত্রের আকার দেখতে এক বড় গোল মদের পাত্রের মতো । এর ব্যাস প্রায় এক মিটার , যন্ত্রের মাঝখানেব্রোঞ্জের এক মোটা দণ্ড , দণ্ডের চার পাশে আটটি ব্রোঞ্জের চিকন ছড়ি , যন্ত্রের বাইরে আটটি ব্রোঞ্জের তৈরী ড্রাগন আছে , প্রতি ড্রাগন যন্ত্রের ভিতরের একটি ছড়ির সঙ্গে সংযুক্ত । আটটি ড্রাগনের মাথাপূর্ব , দক্ষিণ , পশ্চিম , উত্তর , উত্তর-পূর্ব , দক্ষিণ-পূর্ব , উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম এই আটটি দিকমুখী । প্রতি ড্রাগনের মুখে একটি ব্রোঞ্জের বল আর প্রতিটি ড্রাগনের মাথার নীচে একটি ব্রোঞ্জের ব্যাঙ বসানো। ব্যাঙগুলো মাথা উচু করে মুখ হা করে যেন যে কোনো সময় ড্রাগনের মুখের বল গ্রহন করতে প্রস্তুত । ব্যাঙ ও ড্রাগনের মাথার ভঙ্গিমজাদার , যেন ব্যাঙ ও ড্রাগন খেলছে । তাই অধিবাসীরা ব্যাঙ ও ড্রাগনের বল খেলা দিয়ে চান হেনের ভূকম্প যন্ত্রের বণর্না করতেন । যদি কোনো দিকে ভূমিকম্প ঘটে , তাহলে এই যন্ত্রের ব্রোঞ্জের ছড়ি সেই দিকে ঝুঁকবে , সেই ছড়ির সঙ্গে সংযুক্ত ড্রাগনের মুখ খুলবে , মুখের বল পড়ে নীচের ব্যাঙয়ের মুখে পড়বে । ব্রোঞ্জের বল ব্যাঙয়ের মুখে পড়ার সময় একটা বড় শব্দ হবে । এই শব্দই ভুমিকম্পের পূবার্ভাস । ব্রোঞ্জের বল পড়ার শব্দ শুনে অধিবাসীরা জানতে পারবেন কোনো দিকে ভূমিকম্প হয়েছে , সরকার সঙ্গে সঙ্গে পরিত্রাণের কাজ শুরু করতে পারে ।
খৃষ্টীয় ১৩৩ সালে লোইয়ান শহরে সংঘটিত ভূমিকম্প আর এর পরবর্তী চার বছরে লোইয়ান অঞ্চলে সংঘটিত তিনবার ভূমিকম্প চান হেনের তৈরী এই ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র পরিমাপ করতে পেরেছিলো । কিন্তু খৃষ্টীয় ১৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেচান হেন আবিষ্কার করেন পশ্চিম দিকের সেই ড্রাগনের মুখের ব্রোঞ্জের বল নীচেরব্যাংয়ের মুখে পড়েছে । কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীরাভূমিকম্পের কোনো লক্ষণ অনুভব করেন নি । এই সময় যারা চান হেনের ভূকম্প যন্ত্র সম্বন্ধে সন্দেহ করেন , তারা বলেন , চান হেনের এই যন্ত্রের কোনো ঠিক নেই , শুধু লোইয়ানের আশেপাশের ভূমিকম্প পরিমাপ করতে পারে । কিন্তু তিন চার দিন পর লোইয়ানের পশ্চিমে অবস্থিত কান সু প্রদেশের দূত এসে কান সু প্রদেশে ভূমিকম্প ঘটার খবর নিয়ে এলেন । তখন থেকে সবাই পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে চান হেনের তৈরী ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র শুধু এক মজার খেলনা নয় , এই যন্ত্র একটি বৈজ্ঞানিক পরিমাপক যন্ত্র । এই সময় থেকে চীনের পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে ভূমিকম্প পরিমাপ ও লিপিবদ্ধ করার ইতিহাস শুরু হয় ।
|