চিংছির কাহিনী


       সবাই জানেন দক্ষিণ চীনের প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর বাগান বিশ্ববিখ্যাত । উত্তর চীনেও এরকম একটি বাগান আছে । এই বাগান হচ্ছে সানসি প্রদেশের থাই ইইউয়ান শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত চিংছি ।  
  চিংছি থাই ইউয়ান শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকন্ঠের সুয়েনউন পাহাড়ে চিং নদীর উত্পত্তি স্থলে অবস্থিত । এই বাগানের চার পাশে পাহাড় ও নদনদী , বাগানে প্রায় এক শ’টিছোট বড় হল , প্যাভিলিয়ণ , সেতু ও প্যাগোডা ছবির মতো এক মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি করে । পর্যটকরা এই বাগানে বেড়াতে গেলে এই সুন্দর দৃশ্য দেখে ফিরে যেতে চান না । এই সুন্দর বাগান চিংছি সম্পর্কে একটি কাহিনীও আছে । 

   খৃষ্টপূর্ব ১০৬৪ সালে চৌ রাজবংশের প্রথম রাজা চৌউওয়ান সান রাজবংশ নিশ্চিহৃ করার দু’বছর পরই মৃত্যুবরণ করেন । তার ছেলে চিসুন উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হন , তিনিই চৌছেনওয়ান । রাজা হওয়ার সময় চৌছেনওয়ান ছোটছিলেন । প্রতিদিন মন্ত্রী চৌকন রাজা চিসুনকে পিঠে বহন করে রাজপ্রাসাদে মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন । রাজার বয়স কম বলে মন্ত্রী চৌকন রাজার জন্য শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করেন । চৌকন একজন অনুগত মন্ত্রী। তিনি রাজার জন্য বেশ কয়েকবার অভুত্থান দমন করেন , অল্পবয়সী রাজাকে এক যোগ্য রাজায় পরিণত হওয়ার জন্য তিনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন নি । 

  একদিন রাজা ছেনওয়ান ও তার ভাই সুইয়ু রাজপ্রাসাদের বাগানে খেলছিলেন । রাজা একটি গাছের পাতাকে স্থানীয় শাসন কর্তাকে নিয়োগ করার সময় দেওয়া দামী পাথরের ইয়ু কুইয়ের আকার কেটে সুইয়ুকে ঠাট্টা করে বলেন , আমি তোমাকে ইয়ুকুই দিয়ে স্থানীয় শাসনকর্তা নিয়োগ দিলাম । কয়েক দিন পর চৌকন এই খবর পেয়ে ছেনওয়ানকে বলেন , আপনাকে সুনইয়ুকে স্থানীয় শাসন কর্তা নিয়োগের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে । চেনওয়ান বলেন , আমি ঠাট্টা করে ভাইকে এই কথা বলেছি । চৌকন মুখ গম্ভীর করে বলেন , রাজা ইচ্ছা করে কথা বলতে পারেন না । রাজা যা কথা বলেন , তাই কার্যকরী করতে হবে । তাই ছেনওয়ান তার কথা অনুসারে সুনইয়ুকে থান অঞ্চলের শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ করলেন ।  

  তখনকার থান অঞ্চল আজকের সানসি প্রদেশের ইছেন জেলা । সুইয়ু বড় হওয়ার পরথান অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীর জন্য অনেক ভালো কাজ করেছেন । তিনি কৃষির উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতেন এবং জলসেচ ও জননিস্কাশনের ব্যবস্থা নিতেন । এইসব ব্যবস্থার কল্যানে অধিবাসীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারেন । প্রবাহমান চিন নদী থান অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতা নদী বলে পরে সুইয়ুর ছেলে সিয়েফুথান অঞ্চলের নামচিন দিলেন । সেই সময় থেকে সানসি প্রদেশকে চিং বলা শুরু হয় । সুইয়ুর স্মৃতির জন্য স্থানীয় অধিবাসীরা চিং নদীর উত্পত্তিস্থলে একটি মন্দির তৈরি করেন এবং তাকে সুইয়ু মন্দির বলেন , এই মন্দিরই আজকের চিংছি ।  

  চিংছির নিমার্ণ সময় এখনও স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা যায় না । খৃষ্টীয় ৪২২ সাল থেকে ৫৭২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী উত্তর ওয়েই রাজবংশের সময় রচিত ‘ সুইচিনচু ’তে চিংছি সম্পর্কিত বিবরণ আছে । এ থেকে বোঝা যায় চিংছির ইতিহাস উত্তর ওয়ে রাজবংশ থেকে হিসাব করলেও এক হাজারের বেশি দীর্ঘ ।চিংছির বেশ কয়েকবার পুনর্নিমাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়েছিলো । খৃষ্টীয় ৬৪৬ সালে থান রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা লিসিমিন চিংছিতে গিয়ে ফলকে একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ লিখেন এবং চিংছি সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন । একাদশ শতাব্দীর সময় সুন রাজবংশের রাজা সুইয়ুর মা ইচিয়ানের জন্য বিরাটাকার সেনমুতিয়েন নিমার্ণ করেন । পরবর্তীকালে সেনমুতিয়েনকে কেন্দ্র করেঅনেক স্থাপত্য নির্মিত হয় । ইতিহাসের বিভিন্ন সময় নির্মিত সুইচিনথাই , হুইসিয়েন সেতু , চিনরেনথাই ও নানলাওছুয়েন প্যাভিলিয়ন প্রভৃতি স্থাপত্য চিংছিকে আরো সুন্দর করে তুলেছে । পর্যটকদের চোখে চিনছিযেমন একটি বড়মন্দির , তেমনি রাজপ্রাসাদের একটি বড় বাগান । 

   চিংছিতে শুধু ইতিহাসের বিভিন্ন সময়পর্বে নির্মিত সুন্দর সুন্দর স্থাপত্যগুলো ছাড়াও নামকরা দুটি গাছ আছে । এই দু’টি গাছ হলো চৌ রাজবংশের সাইপ্রাস গাছ ও সুই রাজবংশের চানীজ স্কল্যার গাছ । ঐতিহাসিক পুথিপত্রে বলা হয়েছে , সেনমুতিয়েনের পশ্চিম দিকে অবস্থিতসাইপ্রাস গাছটি পশ্চিম চৌ রাজবংশের সময় লাগানো হয়েছিলো । গাছটি সোজাভাবে না দাড়িয়ে গাছের ডাল দক্ষিণ দিকে ঝুঁকে সেনমুতিয়েনের উপরে পড়ে । এই গাছের ইতিহাস দু হাজারেরও বেশি দীর্ঘ । সুই রাজবংশে লাগানো চানীজ স্কল্যার গাছের ইতিহাসও এক হাজারের বেশি। এই হাজার বছর পূরনো চানীজ স্কল্যার গাছ বেশ উচু , এখনও জ্যান্ত আছে ।এই গাছের ছায়া , পাশের নিস্তব্ধ পাহাড় আর ঝরনার পানিমধুর শব্দ চিংছিকে আরো সুন্দর করে তোলে ।সানসি প্রদেশে ভ্রমণ করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই চিংছির মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে হবে ।