লু পাহাড়ের কাহিনী


       লু পাহাড় দক্ষিণ চীনের চিয়াংসি প্রদেশের উত্তর ভাগে অবস্থিত । লু পাহাড় তার মহিমাময় চুড়া ও মনোরম দৃশ্যের জন্য চীনের একটি বিখ্যাত দশর্নীয় স্থানে পরিণত হয়েছে ।  

  প্রাচীনকাল থেকেই অসংখ্য চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিকচিত্রকর্ম সৃষ্টি ও সাহিত্য রচনার জন্য লু পাহাড়েযেতেন । তাইলু পাহাড় চীনের প্রচুর চিত্রকর্ম ও কবিতার উত্পত্তি স্থান বলা যায় । অষ্টম শতাব্দীর থান রাজবংশের বিখ্যাত কবি লি পাই লু পাহাড়ের জলপ্রপাতের বণর্না দিয়ে একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন । তিনি তার কবিতায় লিখেছেনঃপ্রচন্ড রোদে লু পাহাড়ের সিয়ান লু চুড়ার ধোঁয়া লালচেহয়ে উঠে ,জলপ্রপাত একটি রুপালী চেনের মতো দু’টি চুড়ার মধ্যে ঝুলানো ।জলপ্রপাতের পানি খাড়া পাহাড়ের উপর সোজা নীচে পড়ছে , ঠিক যেন স্বর্গের রুপালী নদী পৃথিবীতে পড়ছে । সুং রাজবংশের সাহিত্যিক সুসি একাধিকবার লু পাহাড় ভ্রমণ করেছিলেন । তিনি ‘ থিসিলিনপি ’ নামে তার একটি কবিতায় লিখেছেনঃ সমতলভাবে দেখলেপ্রচুর পাহাড় ,লম্বাভাবে দেখলে অসংখ্য চুড়া , সবর্ত্রই উচুনীচু পাহাড় । লু পাহাড়ে থাকার দরুণই গোটা পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায় না । এই কবিতায় সুসি লু পাহাড়েরদৃশ্য বণর্নার মাধ্যমে এক দার্শনিক চিন্তাধারাও ব্যাখ্যা করেছেন ।  

  লু পাহাড়ের আরো দু’টি নাম হলো ‘ খুয়ান লু ’ ও ‘ খুয়ান পাহাড় ’। একটি উপকথায় বলা হয়েছে , খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর চৌ রাজবংশের সময় খুয়ান সু নামে এক ব্যক্তি লু পাহাড়ে তাও ধর্মের জাদুবিদ্যাগবেষণা করেন। চৌরাজ্যের রাজা এই খবর পেয়ে বেশ কয়েকবার লোক পাঠিয়ে তাকে রাজ্যের জন্য কাজ করার আমন্ত্রণ জানান । কিন্তু খুয়ানসু প্রতিবারই পাহাড়ে লুকিয়ে রাজার দূতের সঙ্গে দেখা করেন না । পরে খুয়ানসু অদৃশ্য হলেন । স্থানীয় লোকেরা বলেন তিনি আকাশের দেবতা হলেন , তাই তারা খুয়ানসুর থাকার ঘরকে ‘ সেনসিয়েন চি লু ’ বলেন , এর অর্থ দেবতার ঘর । তাই তারা এই পাহাড়কে লু পাহাড়অথবা খুয়ান পাহাড় ও খুয়ান লু বলেন । 

   খৃষ্টীয় ৩৮১ সালে পূর্ব চিন রাজবংশের সময় প্রবীণ সন্ন্যাসী হুই ইউয়েন ও তার ছাত্ররা স্থানীয় সরকারের সাহায্যে লু পাহাড়ে তুংলিং মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দির বৌদ্ধধর্মের মহাযান সম্প্রদায়ের প্রধান শাখা—চিনথুচুনের উত্পত্তি স্থল ও দক্ষিণ চীনের বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে । প্রবীণ সন্ন্যাসী হুই ইউয়ান লু পাহাড়ের এই মন্দিরে ৩৬ বছর ধমর্শাস্ত্র চর্চা করেছিলেন , স্থানীয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন । 

  লু পাহাড়ের তুংলিন মন্দির ও প্রবীণ সন্ন্যাসী হুই ইউয়ান সম্বন্ধে অনেক উপকথা আছে । একটি উপকথায় বলা হয়েছে , তুংলিন মন্দির নিমার্ণের সময় নিমার্ণ উপকরণ যথেষ্ঠ নয় বলে সন্ন্যাসী হুই ইউয়ান উদ্বিগ্ন । হঠাত একদিন রাতে প্রচন্ড বজ্রপাতের পর মুষলধারে বৃষ্টি হয় । সন্ন্যাসীরা কেউ বাইরে যাননি।পরদিনবৃষ্টি থেমে সূর্য উঠে । সন্ন্যাসীরা মন্দির থেকে বের হয়ে আবিষ্কার করেন মন্দিরের সামনে একটি পুকুর দেখা দিয়েছে । পুকুরের পানির উপরে প্রচুর কাঠ ভাসছে । হুই ইউয়ান মনে করেন এইসব কাঠ আকাশের দেবতা তুংলিন মন্দিরের জন্য পাঠিয়েছেন । তিনি এই সব কাঠ দিয়ে মন্দিরের এক বড় হল নিমার্ণ করেন । তিনি এই হলটিকে স্বর্গীয় হল আরমন্দিরের সামনের পুকুরকে কাঠ ভাসা পুকুর নাম দিলেন । 

   তুংলিন মন্দিরের কাছে সাদা পদ্ম নামে একটি পুকুর আছে । এই পুকুরের সচ্ছল পানিতে প্রচুর সাদা রঙের পদ্ম ফুল আছে । একটি উপকথায় বলা হয়েছে , এই সাদা পদ্ম পুকুর পূর্ব চিং রাজবংশের বিখ্যাত ব্যক্তি সিয়ে লিনইউয়েন খনন করেছেন । সিয়ে লিনইউয়েন পূর্ব চিং রাজবংশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সিয়ে সুয়েনের গ্রেট নাতী ও বিখ্যাত হস্তলিপিকার ওয়াং সিচিরভাইপো । সিয়ে লিনইউয়েন এক দক্ষ ও অহংকারি ব্যক্তি । তিনি লু পাহাড়ে গিয়েপ্রবীণ সন্ন্যাসী হুই ইউয়ানের প্রতিষ্ঠা সাদা পদ্ম গোষ্ঠীতে অংশ নেওয়ার অনুরোধ জানালেন । হুই ইউয়ান প্রথম দিকে সিয়ে লিনইউয়েনের অনুরোধে রাজী হননি । তিনি সিয়ে লিনইউয়েনকে বললেন , আপনার মন এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি । আপনি প্রথমে ধৈর্যসহকারে তিনটি পদ্মফুলের পুকুর খনন করেন । যখন আপনার মন পদ্ম ফুলের মতো পরিষ্কার ও শান্ত হবে , তখন আপনি আমাদের গোষ্ঠীতে অংশ নিতে পারবেন ।সিয়ে লিনইউয়েন প্রবীণ সন্ন্যাসী হুইইউয়েনের কথা অনুসারে তিনটি পুকুর খননের পর পদ্ম গোষ্ঠীর সদস্য হলেন । পরে হুইইউয়ান ও সিয়ে লিনইউয়েন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন । হুইইউয়ানের মৃত্যুর পর সিয়ে লিনইউয়েন বিশেষ ভাবে চিয়েনখান ( আজকের নানচিং শহর ) থেকে লু পাহাড়ে গিয়ে হুই ইউয়ানের সমাধিস্থলে ফলকে তার স্মৃতির জন্য একটিপ্রবন্ধ লিখেন । 

  লু পাহাড়ে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিগুলো ছাড়াপ্রাকৃতিক দৃশ্যও সুন্দ । লু পাহাড় চীনের একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান ।