ছিয়েনলিনের অক্ষরহীন ফলকের কাহিনী


       পশ্চিম চীনের শানসি প্রদেশের উয়ে নদীর উত্তরে অবস্থিত ছিয়েনলিন হলো চীনের দু হাজার বছর স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ইতিহাসে একমাত্র দু’জন রাজা একসাথে কবরস্থ করা একটি সমাধিস্থল । এই সমাধিস্থলের দু’জন রাজা হলেন থান রাজবংশের রাজা লি চি ও চৌরাজ্যের রাজা উচেথিয়েন । তারা দম্পতি হলেও দুজনই রাজা ছিলেন । উচেথিনে চীনের ইতিহাসের একমাত্র নারী রাজা । তার জীবন সম্পর্কিত অনেক কাহিনী আছে । তার মৃত্যুর পর সমাধিস্থলের সামনে একটি ফলক তৈরি করা হয় । কিন্তু ফলকে কোনো অক্ষর নেই । চীন ছিয়েনলিনকে বিশ্ব সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের তালিকায় অন্তর্ভূক্তের আবেদন জানাচ্ছে । 

  খৃষ্টীয় ৬২৪ সালে উচেথিয়েনের জন্ম । ১৪ বছর বয়সে তিনি রাজপ্রাসাদে ভর্তি হয়ে থান রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা থানথাইচুনের উপপত্নী হন।উচেথিয়েন অল্প বয়স থেকেই তার দৃঢতা ও সাহস দেখিয়েছেন । রাজা থানথাইচুনের একটি খারাপ মেজাজের ঘোড়া ছিলো ।কেউ ঘোড়াটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না ।উচেথিয়েন রাজাকে বলেন , আমি ঘোড়াটি বশে আনতে পারি । তবে আমাকে লোহার চাবুক ও ছুরি দিতে হবে । আমি প্রথমে লোহার চাবুক দিয়ে এই ঘোড়াকে মারবো , বশীভূত না হলে আমি চাবুক দিয়ে তার মাথায় আঘাত হানবো , ঘোড়া প্রতিরোধ করলে আমি ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে দেবো । তার কথা শুনে রাজা থানথাইচুন অবাক হলেন , তিনি মনে করেন একজন মেয়েমানুষের এই ধরনের হিংসাত্মক কথা বলা উচিত নয় । কিন্তু তার ছেলে লি চি গোপনে নিজের চেয়ে চার বছর বড় এই মেয়েকে ভালোবাসতে শুরু করেন ।  

  রাজা থানথাইচুনের মৃত্যুর পর নিয়ম অনুসারে উচেথিয়েন চুল কেটে মন্দিরে সন্ন্যাসীনী হলেন । লিচি থান রাজবংশের রাজা হলেন , তিনি উচেথিয়েনকে ভুলতে পারেন না । তাই তিনি কিছুদিন পর মন্দির থেকে উচেথিয়েনকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে নিজের উপপত্নী করলেন । উচেথিয়েন উপপত্নীর মর্যাদা পেয়ে সন্তুষ্ট হননি , তিনি রানী হতে চান । তাই উচেথিয়েন একটি মতলব সৃষ্টি করেন । রাণী অসুস্থ বলে বাচ্চা জন্ম নিতে পারেন না । কিন্তু বাচ্চাকে খুব আদর করেন । একদিন রাণী উচেথিয়েনের নবজাত মেয়েকে দেখতে গেলেন । রাণী চলে যাওয়া সঙ্গে সঙ্গে উচেথিয়েন নিজের মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করেন এবং মৃতদেহের উপর লেপ রাখেন । একটু পর রাজা থান কাওচুন মেয়ে দেখতে আসেন , লেপ খুলে মেয়েটির মৃতদেহ দেখে তিনি অবাক হলেন । তিনি প্রাসাদের ভৃত্যদের জিজ্ঞেস করেন যে কে এই ঘরে এসেছিল । ভৃত্যরা বলেন একটু আগে রাণী এখানে এসেছিলেন । উচেথিয়েন এই সময় দুঃখে অজ্ঞান হওয়ার ভান করেন । রাজা রাগের মাথায় মনে করেন রাণী এই মেয়েকে হত্যা করেছেন , তাইরাণীকে ঘৃণা করতে শুরু করেন । উচেথিয়েনের ফন্দিতে রাজা কিছুদিন পর রাণীকে তালাক দিয়েউচেথিয়েনকে রাণী করার সিদ্ধান্ত নিলেন । 

  রাণী হওয়ার পর উচেথিয়েনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধকরণের নিয়ম উপেক্ষা করেরাজ্যের প্রশাসনে মত প্রকাশ করতে শুরু করেন এবং রাজা লিচিকেও তুচ্ছকরেন । পরে রাজা থানকাওচুন বাধ্য হয়ে রাজ্যের প্রশাসনের ভার উচেথিয়েনকে দেন । রাজপ্রাসাদের মন্ত্রী ও কর্মচারীরা উচেথিয়েন ও থানকাওচুনকে ‘ আরসেন ’ বলেন , ‘ আরসেনের ’ অর্থ হলো দুই কর্তা । 

  রাজা থানকাওচুনের মৃত্যুর পর উচেথিয়েন একা প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেন । তিনি পর পর থান রাজবংশের দু’জন রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং ৬৭ বছরবয়সেথান রাজবংশের নাম চৌ রাজবংশে পরিবর্তন করেন ।উচেথিয়েন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা হলেন । তিনি চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ রাজা আর চীনের ইতিহাসের একমাত্র মহিলা রাজা । 

  রাজা হওয়ার পর উচেথিয়েন ভিন্নমতপোষনকারী ও থান রাজবংশের রাজকীয় পরিবারের অভিজাতদের হত্যা করার আদেশ জারি করেন , এমনকিথানরাজবংশের রাজার উত্তরাধিকারী ,নিজের ছেলেকেও তিনি বরদাস্ত করেন না । থান রাজবংশের মন্ত্রী সুই চিংইয়ে ও লোপিনওয়াং থান রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ইয়াংচৌতে উচেথিয়েনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান অনুষ্ঠান করেন । লোপিনওয়াং একটি প্রবন্ধ লিখে উচেথিয়েনের নিন্দা করেদেশবাসীদের উদ্দেশ্যে তার বিরোধিতা করার আহ্বান জানান । উচেথিয়েন এই প্রবন্ধ পড়ে মন্ত্রীদের জিজ্ঞেস করেন , এই প্রবন্ধ কে লিখেছে ? মন্ত্রীরা বলেন , সাবেক মন্ত্রী লোপিনওয়াং এই প্রবন্ধ লিখেছেন । উচেথিয়েন বলেন , এমন এক দক্ষ ব্যক্তিকে আমি আমার চোখের বাইরে থাকতে দেবো না । তাই তিনি তিন লক্ষ সৈন্য ইয়াংচৌয়ে পাঠানোর আদেশ জারি করেন । উচেথিয়েনের সৈন্যরাসুইচিং ও লোপিনওয়ানের বাহিনীকে পরাজিত করে এবং এই দু’জন সাবেক মন্ত্রীকে হত্যা করেন ।  

  অন্য দিকে উচেথিয়েন দেশশাসনে কৃষকদের সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেন । যোগ্য ব্যক্তিদের গুরু দায়িত্ব দেন , রাজপরিবারের সদস্যদের কড়া শাসন করেন এবং নারীর মর্যাদা উন্নত করারব্যবস্থা নেন । তিনি রাজা হিসেবে ১৫ বছর দেশশাসন করেছিলেন ,আসলে তার দেশশাসনের সময় ৫০ বছর স্থায়ী ছিলো । তার শাসনাধীনে দেশ শক্তিশালী , সামাজিক শৃঙ্খলা ভালো , অথর্নীতির বিকাশ দ্রুত হয় । উচেথিয়েনএকাধিকবার বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং থানরাজবংশের সমৃদ্ধি বজায় রাখার চেষ্টা করেন । 

  ৮২ বছর বয়সে উচেথিয়েনের মৃত্যু হয় । মৃত্যুর পর তাকে স্বামীর সঙ্গে ছিয়েলিনে সমাধিস্থ করা হয়েছে । তাদের সমাধিস্থলের সামনে একটি অক্ষরহীন ফলক আছে । বড় পাথর দিয়ে তৈরি এই ফলকের উচ্চতা প্রায় আট মিটার , চওড়া দুই মিটার । ফলকটি সুন্দরভাবে খোদাই করাসত্বেও এতে কোনো অক্ষর নেই । উচেথিয়েনের সমাধিস্থলের ফলকে কোনো কিছু না লেখার কারণ সম্পর্কে নানা ধরনের উপকথা আছে । কেউ কেউ বলেন , নিজের কীর্তি প্রশংসার জন্য উচিয়েথিয়েন অক্ষরহীন ফলক রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন , তিনি এই ফলকের মাধ্যমে বলতে চান , আমার অবদান ও কীর্তি এতো বড় যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । আরো কিছু লোক মনে করেন , উচেথিয়েন চীনের ঐতিহ্যিক পুরুষ মানুষ ক্ষমতা অধিষ্ঠানের ব্যবস্থা উচ্ছেদ করেছেন বলে পূর্বপুরুষদের মুখোমুখি হতে পারেন না , তাই ফলকে কিছু না লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । আরো কিছু লোক মনে করেন , উচেথিনের মৃত্যুর পর স্বামীর সঙ্গে একই কবরে রাখা হয়েছে বলে ফলকে তাকে থান রাজবংশের রাণীনাচৌ রাজবংশের রাজা লেখা হবে সেটা এক কঠিন ব্যাপার , তাই ফলকে কিছু না লেখাই ভালো । বেশির ভাগ লোক মনে করেন ,উচেথিয়েন যে নিজের জন্য একটি অক্ষরহীন ফলকখাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলেন , তা থেকে তার ধীশক্তি প্রকাশ পেয়েছে । তিনি জানেন তার উত্তরসুরীরা তার জীবন সম্বন্ধে নানান ধরনের মূল্যায়ন করবেন , তাই তিনি ফলকে কিছু না লিখে অবদান ও দোষ উত্তরসুরীদের মুল্যায়ন করতেদেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ।