সেনইয়ানের রাজপ্রাসাদের কাহিনী


       উত্তরপূর্ব চীনের সেনইয়ান শহরেও একটি রাজপ্রাসাদ আছে । চীনের রাজকীয় স্থাপত্যগুলোর মধ্যে এই প্রাসাদের আকার ও বজায় রাখার অবস্থা পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদের পরই তার স্থান । সেনইয়ানের রাজপ্রাসাদমান জাতির রাজা নির্মাণ করেছিলেন । এই প্রাসাদের ইতিহাস আর তার সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্ট্য দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ।  

  উত্তর-পূর্ব চীনের লিয়াও নিন প্রদেশের রাজধানী সেনইয়ানের পুরনো নগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ ছিং রাজবংশের রাজপ্রাসাদ ছিলো । এই প্রাসাদের ইতিহাস বৈশিষ্ট্যময় বলা যায় । সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চীনের উত্তর-পূর্ব ভ্রাম্যমান মান জাতি চিং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে । এরপর চিং রাজ্যের রাজা নুরহাছি সেনইয়ানকে চিং রাজ্যের রাজধানী নির্ধারণ করেন এবং সেনইয়ানে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। নুরহাছির ছেলে হুয়ান থাইচি রাজা হওয়ার পর রাজ্যের নাম ছিং পরিবর্তন করেন এবং রাজপ্রাসাদের নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন , এটাই সেনইয়াং রাজপ্রাসাদ । ছিং রাজবংশের প্রথম দুজন রাজা হুয়ানথাইচি ও ফুলিন সেনইয়ান রাজপ্রাসাদে রাজা হয়েছিলেন । পরে ছিং বাহিনী মধ্য চীনে গিয়ে মিং রাজবংশের পতন ঘটিয়ে চীনের নতুন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে । তখন থেকে ছিং রাজবংশের রাজধানী সেনইয়াং থেকে পেইচিংয়ে স্থানান্তরিত হয় । এই সময় থেকে ছিং রাজবংশের রাজারা পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদে থাকতে শুরু করেন । সেংইয়াং ছিং রাজবংশের বিকল্প রাজধানী আর সেনইয়ানের রাজপ্রাসাদ বিকল্প রাজধানীর রাজপ্রাসাদ হয়েছে । 

   সেনইয়ান রাজপ্রাসাদের আয়তন ৬০ হাজার বর্গমিটার । এতে ৭০টির বেশি স্থাপত্যের তিন শ’রও বেশি ঘর আছে । চীনের ঐতিহ্যিক রাজপ্রাসাদের তুলনায় সেনইয়ান রাজপ্রাসাদের বৈশিষ্ট্য হলো এই প্রাসাদের ঘণ ভ্রাম্যমাণ জাতির স্থাপত্য শৈলী । সেনইয়ান রাজপ্রসাদের স্থাপত্যগুলো মধ্য , পশ্চিম ও পশ্চিম তিন ভাগে বিভক্ত । এই তিন ভাগের স্থাপত্যের মধ্যে পূর্ব ভাগের স্থাপত্যের অবস্থান সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় । পূর্ব অংশের প্রধান স্থাপত্য হলো তাচেন হল , এটা হলো রাজার দৈনন্দিন প্রশাসনের কাজ করা আর বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার হল । এই বড় হলের দুই পাশে দশটি প্যাভিলিয়ান আকারের ক্ষুদ্র হল আছে । এই দশটি ক্ষুদ্র হল উত্তর থেকে দক্ষিণে দুই দল বড় পাখি উড়ার আকারে নির্মিত হয়েছে , এটাই সেনইয়ান রাজপ্রসাদের সিওয়ানথিন । এই দশটি প্যাভিলিয়ন দশজন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ।আসলে রাজার থাকা তাচেন হলও একটি বড় প্যাভিলিয়ন , তবে এই বড় প্যাভিলিয়ানের আকার বড় , ভিতরের সাজানো সুন্দর বলে তাকে প্রাসাদ বলা হয়েছে । তাচেন হল ও সিওয়ানথিনের স্থাপত্য শৈলী ভ্রাম্যমাণ জাতির তাবু থেকে আসে । এই এগারটি প্যাভিলিয়ান এগারটি তাবুর প্রতীক । ভ্রাম্যমাণ তাবু থেকে স্থায়ী প্যাভিলিয়ানে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে ভ্রাম্যমাণ জাতির সংস্কৃতির বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে । 

  সেনইয়ান রাজপ্রাসাদে মান জাতির রীতিনীতি সম্পর্কিত জিনিস দেখার মতো । যেমন রাজপ্রাসাদের মধ্যভাগের ছিংনিন প্রাসাদের বড় দরজার সামনে একটি সাত মিটার লম্বা কাঠের দণ্ড খাড়া করে রাখা হয় । দামি পাথরেরমঞ্চের উপর খাড়া করা এই দণ্ডের উপর ভাগে টিনের তৈরি একটি পাত্র আছে । সুন্দরভাবে সাজানো রাজপ্রাসাদে এই ধরনের একটি কাঠের দণ্ডদেখতে যেন চারপাশের রাজকীয় স্থাপত্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় । কিন্তু এই দণ্ড এক সাধারণ দণ্ড নয় , এটির নাম সোলুন দণ্ড ।মান জাতির মানুষ আকাশের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পন ও প্রার্থনার সময় এই দণ্ডব্যবহার করেন । মান জাতির রীতি অনুসারে আকাশের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পন করার সময় দণ্ডের উপর ভাগের টিনের পাত্রে চাউল ওশুয়রেরনাড়িভুড়ি রাখতে হবে । এইসব খাবার কাকের জন্য দেওয়া হয় । এই রীতির একটি উপকথাও আছে । উপকথায় বলা হয়েছে , ছিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নুরহাছি রাজা হওয়ার আগে একবার বিপদে পড়েছিলেন । পিছনে শত্রুরা পিছু ধাওয়া করছে , কিন্তু নুরহাছি পালানোর পথ দেখতে পাচ্ছেন না । কোনো উপায় না দেখে নুরহাছি ঘাসের উপর শুয়ে শত্রুদের জন্য অপেক্ষা করেন । ঠিক এই সময় একদল কাক তার গায়ের উপরে পড়ে নুরহাছিকে পুরোপুরি ঢেকে রাখে । নুরহাছিকে দেখতে না পেয়ে শত্রুরা চলে গেল । নুরহাছি বিপদ থেকে মুক্তি পেলেন । পরে নুরহাছি চিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে রাজা হলেন ।কাককে ধন্যবাদ জানানোর জন্য তিনি মান জাতির অধিবাসীদের নিজের বাড়ীর উঠানে খাড়া করা কাঠের দণ্ডের উপরে টিনের পাত্র রাখার নির্দেশ নিলেন । আকাশের প্রতি শ্রদ্ধাতর্পনের সময় পাত্রে সুস্বাদু খাবার রেখে কাককে খাওয়াতে হবে । এটাই সেনইয়ান রাজপ্রাসাদের সোলুন দণ্ডের ইতিহাস ।  

  সেনইয়ান রাজপ্রাসাদে মান জাতির সংস্কৃতি ও রীতিনীতির লক্ষণ সুস্পস্ট।যেমন এই প্রাসাদে রাজা ও মন্ত্রীদের প্রশাসনের কাজ করার হলগুলোর তুলনায় তাদের থাকার হলগুলো বেশি উচ্চ স্থানে নির্মিত। এটা মান জাতির একটি বৈশিষ্ট্য । মানজাতির অধিবাসিরা দিনের বেলায় বনে ঘুরে ঘুরে শিকার করেন , রাত্রে উচু জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন । তবে ছিং রাজবংশেরপ্রথম দিকে শাসকরা মধ্য চীনের হান জাতির সংস্কৃতি গ্রহণ করতে শুরু করেন । তাই সেনইয়ান রাজপ্রাসাদে হান জাতির সংস্কৃতির চিহৃও দেখা যায় । যেমন এই প্রাসাদের প্রধান হলের স্থাপত্য রীতি সুং রাজবংশের স্থাপত্য শৈলী অনুসারে নির্মিত হয়েছে । তাছাড়া হান জাতিরপ্রণালী অনুসারে প্রাসাদের আবাসিক হলগুলোরনাম দেওয়া হয়েছে , যেমন কুয়ান চু ভবনও লিনচি ভবনের নাম হান জাতির বিখ্যাত সাহিত্য রচনা ‘ সিচিং ’ থেকে আসে।  

  সেনইয়ান রাজপ্রাসাদের প্রধান অংশের নির্মাণ কাজ ১৬২৫ সালে শুরু হয় । নির্মাণ কাজ দশ বছর স্থায়ী ছিলো । পরে ছিং রাজবংশের খানসি , ইয়োনচেন ও ছিয়েন লুন –এই তিনজন রাজা প্রাসাদটি পুনর্নিমাণ ও সম্প্রসারণ করেছিলেন । তাই সেনইয়ান রাজপ্রাসাদে হান ,মান , মঙ্গোলিয়া ,হুই আর তিব্বত জাতির স্থাপত্য শৈলী দেখা যায় । সেনইয়ান রাজপ্রাসাদ চীনা জাতির সংস্কৃতি ওএকত্রিত বহুজাতিক চীনের প্রতীক।