সানসি প্রদেশের সুয়েনখোন মন্দির


       মন্দিরগুলো সাধারণতঃ মাটিতে নির্মিত হয় । কিন্তু চীনের সানসি প্রদেশে একটি মন্দির খাড়া পাহাড়ের উপর ঝোলানো আছে , এই মন্দিরের নাম সুয়েনখোন মন্দির । সানসি প্রদেশের উত্তরাংশের তা থোন শহরের কাছে অবস্থিত এই মন্দির এক হাজার চার শ’ বছর আগে নির্মিত হয় । এই মন্দির চীনের বৌদ্ধধর্ম , তাও ধর্ম ও রু ধর্ম—এই তিনধর্মের একটি মন্দির । সুয়েনখোন মন্দিরের আগের নাম ছিলো সুয়েনখোনকে । ঐতিহ্যিক তাও ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সারমর্ম অনুসারে মন্দিরের এই নাম দেওয়া হয়েছিলো । এই মন্দির খাড়া পাহাড়ে ঝোলান হয়েছে বলে পরে এই মন্দিরকে সুয়েনখোন মন্দির নাম দেওয়া হয়েছে , এর মানে পাহাড়ে ঝোলানো মন্দির ।  

  চীনের বিভিন্ন জায়গার স্থাপত্যগুলোর মধ্যে সুয়েনখোন মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী বৈশিষ্ট্যময় । এই মন্দির পাহাড়ের একটি ছোট বেসিনে অবস্থিত । মন্দিরের দুই পাশে এক’ শ মিটারেরও বেশি উচু খাড়া পাহাড় । মন্দিরটি যেন এক পাশের খাড়া পাহাড়ে এঁটে মধ্য আকাশে ঝোলান হয়েছে । মন্দিরটি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ৫০ মিটার উচুতে নির্মিত । দূর থেকে দেখলে মন্দিরটির ছোট বড় ৪০টি ঘর মাত্র দশ-বারোটি কাঠের থামের উপর নির্মাণ করা হয়েছে । মন্দিরের বাইরে পাহাড়ের বড় বড় পাথর যেন মন্দিরের উপর আঁচড়ে পড়ছে । মন্দিরের ৪০টি ঘর সরু পথ দিয়ে সংযুক্ত । এই সরু পথ বেয়ে মন্দির পরিদর্শনের সময় পর্যটকদের ভয় লাগে , তারা আশংকা করেন , তাদের ভর বইতে না পেরে মন্দিরটি বুঝি ভেঙ্গে যাবে । যদিও এই মন্দির পরিদর্শনের সময় পর্যটকরা নিজের পায়ের নীচে কাঠের চি-চি শব্দ শুনতে পান , কিন্তু পাহাড়ে ঝোলানো এই মন্দির আজ পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে । 

  সুয়েনখোন মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীর প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো মিশ্ত্রীর দক্ষতাপূর্ণ নকশা । এই মন্দির খাড়া পাহাড়ে ঝোলানো হয়েছে বলে পাহাড়ের চূড়ার পাথরগুলো ছাতার মতো মন্দিরের উপরে থাকে , ফলেবৃষ্টির পানিমন্দিরে পড়ে না । পাহাড়ের নীচে বন্যা হলে মন্দিরটি বন্যা থেকে রক্ষা পায় । মন্দিরের চার পাশের পাহাড়সুর্যের প্রখর রোদ রোধ করতে পারে । গরমকালে দিনে মাত্র তিন ঘন্টা রোদ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে । তাই সুয়েনখোন মন্দির হাজার বছরের বাতাস ও বৃষ্টির মধ্যেও অক্ষত রয়েছে । 

  সুয়েনখোন মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো পাহাড়ের পাথরের মধ্যে কাঠ ঢুকিয়ে মন্দিরকে পাহাড়ে ঝুলানোর কৌশল । অনেকেই মনে করেন , সুয়েনখোন মন্দিরের মোট ওজন মন্দিরের নীচের দশ-বারোটি খাওয়ার বোলের মতো মোটা কাঠের থামের উপর পড়ে । আসলে এইসব কাঠের থাম মন্দিরকে খাড়া করে নি , পাথরের ভিতরে ঢোকা শক্ত কাঠগুলোই মন্দিরের ওজন বহন করে । এইসব কাঠ স্থানীয় চীনা হেমলক গাছের কাঠ । পাথরের ভিতরে ঢোকানোর আগে কাঠগুলো চার কোনাকার প্রক্রিয়াকরণ করা হয় এবংথোং তেলে ভিজানো হয় , এই ধরনের কাঠ পোকায় ধরে না এবং সহজে নষ্টও হয় না । মন্দিরটি এইসব পাথরের ভিতরে ঢোকা কাঠগুলোর উপর নির্মিত হয়েছে । অবশ্য মন্দিরের নীচের থামগুলোর উপরও মন্দিরের ওজন বহন করে, তবে মন্দিরের বেশির ভাগ ওজন পাথরে ঢোকানো হেমলক কাঠের উপর পড়ে। 

  সুয়েনকোন মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো ডিজাইনের দক্ষতা । মন্দির তৈরির সময় মিশ্ত্রী আশেপাশের পাহাড়ের পাথর ও গুহার সদ্ব্যবহার করেছিলেন । এই মন্দিরের দুটি বৃহত প্রার্থনা প্রাসাদের অন্যতম—সানকুয়ান প্রাসাদই এর একটি উদাহরণ । এই প্রাসাদের সামনে কাঠের তৈরি ঘর , কিন্তু পিছনে মিশ্ত্রী পাহাড়ে অনেক গুহা খনন করে প্রাসাদটি অনেক বড় করে তুলেছেন । এই দুটি বড় প্রার্থনা প্রাসাদ ছাড়া মন্দিরের অন্য ঘরগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট । এই মন্দিরের ৪০টি ছোট বড় ঘরের অবস্থানও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ । এইসব ঘর সাধারণ স্থাপত্য শৈলী অনুসারে নির্মাণ করা হয়নি , কাজেই পর্যটকদের চোখে এই মন্দির ঠিক যেন এক গোলোকধাঁধার মতো ,পরিদর্শনের সময় পর্যটকরা প্রায়ই নিজের পথ হারান । 

  অনেকেই এই প্রশ্ন তুলতে পারেন যে প্রাচীন চীনের অধিবাসীরা কেন মন্দির পাহাড়ের উপর নির্মাণ করেছেন ? আসলে সুয়েনখোন মন্দিরের নীচে তখনকার একটি বড় রাস্তা , প্রতিদিন প্রচুর লোক এই রাস্তায়আসা-যাওয়াকরতেন । এই পথের কাছে একটি মন্দির তৈরি করা স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে সুবিধাজনক । তাছাড়া , এই মন্দিরের পাদদেশে নদীতে প্রায়ইবন্যা দেখা দিতো । স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করতেন সোনালী ড্রাগন বন্যা সৃষ্টি করেছে। তাই তারা নদীর উপরে একটি প্যাগোডা সৃষ্টি করেসোনালী ড্রাগন নিয়ন্ত্রন করতে চান । তাই তারা খাড়া পাহাড়ের মাঝখানে এই সুয়েনখোন মন্দির তৈরি করেন । 

  সুয়েনখোন মন্দিরের ছোট বড় কক্ষগুলোর সংযোগকারী সরু পথের পাথরের দেওয়ালে ‘ কোনসুথিয়েনছিয়াও ’ চারটি অক্ষর খোদাই করা হয়েছে । কোনসু হলেন দু হাজার বছর আগে এই মন্দির নির্মাণের মিশ্ত্রীকোনসুনপান। থিয়েন ছিয়াওয়ের অর্থ হলো স্বর্গের মিশ্ত্রীর মতো দক্ষ ও বুদ্ধিমান । এই চারটে অক্ষরের অর্থ হলো কোনসুপানের মতো দক্ষ ও বুদ্ধিমাণ মিশ্ত্রীরা এইসুন্দর মন্দির নির্মাণ করতে পারেন । কোনসুপান চীনের স্থাপত্য শিল্পের স্বীকৃত দক্ষ মিস্ত্রী । তিনি দু হাজার বছর আগে পাহাড়ের উপর এতো সুন্দর ও মজবুত মন্দির নির্মান করেছিলেন ।