বুদালা ভবনের কাহিনী


       রহস্যময় ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে পৃথিবীর সবচেয়ে উচু ও বৃহত্তম প্রাসাদ আছে । এই প্রাসাদ হলো তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের মন্দির---বুদালা ভবন । 

  খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর সময়তিব্বতের রাজা সুনচানকানপু থান রাজবংশের রাজকুমারী ওয়েনছেনের সঙ্গে বিয়ে করার আগে তাকেস্বাগত জানানোর জন্য পুতালা ভবন নির্মাণ করেছিলেন । এই ভবনের নাম পুতালাহলো সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণ । এই ভবনের আরেকটি নাম হলো ফুথোলো বা থোলো , যার অর্থ হলো কুয়ানসিইং বোধিসত্ত্বার বাসস্থান । পুতালা ভবন তিব্বতের লাসা শহরের হোন পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত । ভবনের উচ্চতা সমুদ্রসমতল থেকে ৩৭০০ মিটার । এর মোট আয়তন তিন লক্ষ ৬০ হাজার বর্গমিটার।পুতালা ভবন লাল ভবন ও সাদা ভবন নিয়ে গঠিত । লাল ভবন মাঝখানে রয়েছে , সাদা ভবন লাল ভবনের দুই পাশে অবস্থিত , দেখতে ভারী সুন্দর ।  

  পুতালা ভবনের কেন্দ্রস্থলে অর্থাত লাল পাহাড়ের চূড়ায় রাজা সুনচানকানপুর বৌদ্ধশাস্ত্র পাঠ ও প্রার্থনা ঘর । প্রার্থনা ঘরে সুনচানকানপু , রাজকুমারী ওয়েনছেন , নেপালের রাজকুমারী ঝিজুন আর সুনচানকানপুর মন্ত্রী লুতুনচানের প্রতিকৃতি রাখা হয়েছে , এটা সপ্তম শতাব্দীর টুবো আমলের শিল্পকর্ম । 

(সুনচানকানপুর ছবি , রাজকুমারী ওয়েনছেনের ছবি )

  যদিও পুতালা ভবন তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের স্থাপত্য , তবু এই ভবনে হান জাতিরখোদাইকর্ম সম্বলিত থাম আছে । এটা হলো ১৩ শ’ বছর আগে তিব্বত ও হান জাতির মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে সুসম্পর্ক স্থাপন আর তিব্বত ও হান জাতির ঐক্যের প্রমাণ । তিব্বতী জাতির লোকই হোক আর হান জাতির লোকই হোক , তের’ শ বছর আগের সেই সুন্দর কাহিনী তাদের ছেলেমেয়ে ও নাতিনাত্নীকে বলছেন । 

  সপ্তম শতাব্দীর সময়টুবো রাজ্যের আমলে তিব্বতী রাজা সুনচানকানপুভালো রাজা ছিলেন । থান রাজবংশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা ও থান রাজবংশের উন্নত প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিআমদানির জন্য সুনচানকানপু থান রাজবংশের রাজকুমারী ওয়েনছেনের সঙ্গে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।সুচানকানপুর দূত লুতুং উপহার নিয়ে থান রাজবংশের রাজধানী ছানআনে গিয়েছিলেন । ছানআনে গিয়েই তিনি জানতে পেরেছেন যে নিকটবর্তী দেশগুলোর রাজারাও রাজকুমারী ওয়েনছেনের সঙ্গে বিয়ে করার জন্য দূত পাঠিয়েছেন । থান রাজবংশের রাজা থানথাইচুন তিনটি প্রশ্ন তুলেদূতদের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিলেন । দূতদের মধ্যে যিনি তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন ,সেই দেশের রাজা রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে করতে পারবেন । 

   প্রথম প্রশ্ন হলোবাগানে দশটি কাঠ আছে , এই দশটি কাঠের দুই মাথা দেখতে কোনো তফাত্ নেই । দূতদেরকে এই দশটি কাঠের মধ্যে কোনদিক গাছের মাথার অংশ আর কোনদিক গাছের মূল অংশ—তা’ নির্ণয় করতে হবে । বুদ্ধিমান লুতুং এইসব কাঠ পানিতে রাখলেন ।পানিতেকাঠগুলো সমতলভাবে থাকে না । গাছের মূলভাগের কাঠের ঘনত্বের পরিমান বেশি বলে পানির দিকে ঝুকে , গাছের মাথাভাগের কাঠের ঘনত্বের পরিমান অপেক্ষাকৃত কম বলে পানিতে ভাসে । লুতুং সহজেই কাঠগুলোর মাথা ও লেজ নির্ণয় করতে পেরেছেন । 

  রাজা থানথাইচুনের দ্বিতীয় প্রশ্ন হলোঃ রাজার হাতে একটি দামী পাথর আছে , এই দামী পাথরের মাঝখানে একটি সরু ছিদ্র আছে । রাজা দূতদের একটি সুতাছিদ্রের একমাথা থেকে অন্য মাথায় পরানোর নির্দেশ দিলেন । অন্য দূতরা হাতে সুতা দিয়ে ছিদ্রটিতে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন । কিন্তু লুতুং এই সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য ব্যবস্থা নিলেন । তিনি ছিদ্রের এক মাথায় কিছু মধু মাখলেন , তারপর একটি পিপড়ার কোমরে সুতা বেঁধে ছিদ্রের অন্য মাথায় রাখলেন । পিপড়া মধুর গন্ধ পেয়ে ছিদ্রের অন্য মাথার দিকে যেতে শুরু করলো । পিপড়াটি যাতে আরো তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারে , লুতুং ছিদ্রের দিকে ফুঁ দিতে লাগলেন । অল্পক্ষণ পরই পিপড়াটি সুতা নিয়ে ছিদ্রের অন্য মাথায় পৌঁছলো , লুতুং আবার জিতলেন ।  

   রাজা থানথাইচুন তৃতীয় প্রশ্ন উত্থাপন করলেন । তার তৃতীয় প্রশ্ন হলো একশ’টিঘোটকী ও এক শ’টি অশ্ব-শাবক এক সঙ্গে রাখা হয়েছে । দূতদের ঘোটকী ও তার ছেলে নির্ণয় করতে হবে । দূতরা দু শ’টি ঘোড়ার মধ্যে ঘোড়ার মা ও তার ছেলে আলাদা করার জন্য অনেকচেষ্টা করেছেন । তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘোড়ার লোমের রং অনুসারে নির্ণয় করেন , কেউ কেউ ঘোড়ার চেহারা অনুসারে আলাদা করার চেষ্টা করেন । লুতুং কিন্তু তাদের মতো চেষ্টা করেননি । তিনি এক শ’টি ঘড়ার মা ও এক শ’টি ছোট ঘোড়া আলাদা ভাবে আটক করলেন । পরদিন সকালে তিনি ঘটিকাগুলো একটি একটি করে বের করতে শুরু করেন । ছোট ঘোড়া নিজের মা দেখে দুধ খাওয়ার জন্য মায়ের কাছে যেতে শুরু করে । অল্পক্ষনের মধ্যে তিনি ঘটিকা ও তাদের ছেলেদের আলাদা করলেন । লুতুং তিনটি প্রশ্নই সঠিক উত্তর দিয়েছেন দেখে রাজা খুব খুশি । তবে তিনি আরেকটি প্রশ্ন তুললেন , প্রশ্নটি হলো দূতদেরকে পাঁচ শ’জন ঘোমটা দিয়ে ঢাকা মেয়ের মধ্যে রাজকুমারী ওয়েনছেনকে বেছে নিতে হয় । কিন্তু দূতরা রাজকুমারীকে কোনোদিন দেখেন নি , কিভাবে পাঁচশ’জন মেয়ের মধ্যে রাজকুমারী বেছে নিতে পারবেন ?লুতুং জানেন রাজকুমারী ওয়েনছেনএক বিশেষ ধরনের সুগন্ধ পছন্দ করেন । মৌমাছিও এই ধরনের সুগন্ধ পছন্দ করে। তাই রাজকুমারী নির্ণয়ের দিন লুতুং গোপনে কিছু মৌমাছি সঙ্গে নিলেন । তিনি মৌমাছি ছেড়ে দিলেন , মৌমাছিগুলো বিশেষ ধরনের সুগন্ধ পেয়ে ওয়েনছেন রাজকুমারীর দিকে উড়ে গেলো । লুতুং আবার জিতলেন । রাজা থানথাইচুন মনে করেন , থুবোর মন্ত্রী এতো বুদ্ধিমান , সেখানকার রাজা আরো বুদ্ধিমান হবে । তিনি নিজের মেয়ে ওয়েনছেনের সঙ্গে সুনচানকানপুকে বিয়ে দিলেন। 

  এই খবর পেয়ে সুচানকানপু মহা খুশি । রাজকুমারী ওয়েনছেনকে স্বাগত জানানোর জন্য তিনি লাসায় নয় শ’ নিরানব্বইটি ঘর সম্পন্ন পুতালা ভবন নির্মাণেরআদেশ দিলেন । সুচানকানপুর লুতুংকে নিজের দূত হিসেবে পাঠিয়ে থান রাজবংশের রাজকুমারী ওয়েনছেনকে বিয়ে প্রস্তাব করার কাহিনী পুতালা ভবনের দেওয়াল চিত্রে জীবন্তভাবে বণর্না করা হয়েছে ।