পশ্চিম হ্রদের কাহিনী


       পূর্ব চীনেরহানচৌ শহরের পশ্চিম হ্রদের মনোরম দৃশ্য প্রাচীন ও আধুনিক চীনের আর দেশবিদেশের অসংখ্য পর্যটককে মুগ্ধ করে । চতুর্দশ শতাব্দীর সময় ইতালির বিখ্যাত পর্যটক মার্কপোলো হানচৌয়ে পৌছে পশ্চিম হ্রদের মনোরম দৃশ্যের প্রশংসা করে বলেছেন , মানুষ এই হ্রদে এসে চার পাশের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে করতে মনে করেন যেন স্বর্গে উঠেছে । 

   পশ্চিম হ্রদ হচ্ছে পূর্ব চীনের চেচিয়ান প্রদেশের রাজধানী হানচৌ শহরের একটি উজ্জ্বল মুক্তা । পশ্চিম হ্রদের তিন দিক পাহাড় , হ্রদের সচ্ছল পানির উপর চীনের বিখ্যাত দুজন কবি সুতুংফো ও পাইচুইর নামের উপাধি দিয়ে নামকরণ করা দুটি পরিখা আছে । এই দুটি পরিখা যেন দুটি সবুজ রংয়ের রেশমী ফিতার মতো হ্রদের উপর ভাসে । পর্যটকরা এই দুটি দীর্ঘ পরিখার উপরে দাড়িয়ে দূরের পাহাড় , কাছের সচ্ছল পশ্চিম হ্রদ আর চার পাশের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পছন্দ করেন । চীনের বিভিন্ন রাজবংশের কবিরা হানচৌর পশ্চিম হ্রদের দৃশ্য সম্বন্ধে অনেক কবিতা লিখেছিলেন । থান রাজবংশের নামকরা কবি পাইচুই তার কবিতায় লিখেছিলেন , হানচৌকে ছেড়ে যেতে পারি নি , এই মনোরম পশ্চিম হ্রদই আমার মন আকড়ে ধরেছ । সুং রাজবংশের কবি সুতুংফো পশ্চিম হ্রদকে প্রাচীন চীনের সুন্দরী সিশির তুলনা করে লিখেছিলেন , পশ্চিম হ্রদের তিন দিকের পাহাড় সুন্দর , হ্রদের সবুজ সচ্ছল পানি আরো সুন্দর ।এই হ্রদ সিশির মতোসবসময়ই সুন্দর । তার এই কবিতা পশ্চিম হ্রদ সম্পর্কিত একটি সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতায় পরিণত হয়েছে । 

  পশ্চিম হ্রদেরদশটি বিখ্যাত দৃশ্য দেশেবিদেশে বিখ্যাত । পশ্চিম হ্রদের এই দশটি বিখ্যাত দৃশ্য হলোঃ বসন্তের ভোরবেলার সু পরিখা , ছুইউনের পদ্মফুল , পশ্চিম হ্রদের পূর্ণিমা চাঁদ , ভাঙ্গা সেতুর বরফ , উইলোগাছের পাখি , হুয়াকানের সোনালী মাছ , হ্রদের পানিতে চাঁদের প্রতিবিম্ব ছবি , সুর্যাস্তের আলোয রেইফোং টাওয়ার , নানফিংয়ের ঘন্টা আর দুই শৃঙ্গের মধ্যে রঙীন মেঘ । 

  পশ্চিম হ্রদ সম্পর্কে অনেক সুন্দর সুন্দর রুপ কথা আছে । যেমন দশটি দৃশ্যের মধ্যে ভাঙ্গা সেতুর বরফ নামে দৃশ্যে ভাঙ্গা সেতুটি চীনের খ্যাতনামা রুপকথায় ‘ শেত্ব সাপের কাহিনীতে ’ নায়িকা পাইনিয়ানচি ও নায়ক সুইসিয়েনের মিলনের জায়গা । 

  এই উপকথায় বলা হয়েছে , একটি শ্বেত সাপ এক হাজার বছর প্রার্থনার পর পাইনিয়ানচি নামেএক সুন্দরী নারী হলো । অন্য এক সবুজ রঙের সাপ পাঁচ শ’ বছর প্রার্থনা করে সিয়াওছিন নামে এক চঞ্চল যুবতী মেয়েতে পরিণত হলো ।একদিন তারা দুজন এক সঙ্গে পশ্চিম হ্রদে বেড়াতে যান । তারা যখন ভাঙ্গা সেতুতে পৌছেন , পাইনিয়ানচি সেখানে এক সুদর্শন যুবককে দেখলেন , তাকে দেখেই পাইনিয়ানচি মনে মনে তাকে পছন্দ করতে শুরু করেন । এটা দেখে সবুজ সাপ থেকে মানুষে পরিণত সিয়াওছিন মন্ত্র পড়ে মুষলধারে বৃষ্টি সৃষ্টি করেন । যুবক সুইসিয়েন ছাতানিয়ে পশ্চিম হ্রদের পাশে দাড়িয়ে নৌকায় উঠার জন্য অপেক্ষা করছিলেন । 

  এই সময় সুইসিয়েন দেখেছেন পাইনিয়ানচি ও সিয়াওছিন বৃষ্টির পানিতে গায়ের কাপড় ভীজে গেলো । তাই সুইসিয়েন হাতের ছাতা তাদের দিয়ে নিজে দূরেবৃষ্টির মধ্যে দাড়ান । পাইনিয়ানচি সুইসিয়েনের এই কাণ্ড দেখে মনে মনে তাকে আরো ভালোবাসেন । সুইসিয়েনও পাইনিয়ানচিকে ভালোবাসেন , তাই সিয়াও ছিনের সাহায্যে সুইসিয়েনপাইনিয়ানচির সঙ্গে বিয়ে করেন এবং পশ্চিম হ্রদের তীরে একটি ওষুদের দোকান খুলে রোগীদের চিকিত্সা করেন । তারা আশেপাশের অধিবাসিদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করেন ।  

  তাদের সুখী জীবন বেশি দিন টিকেনি । চিংসান মন্দিরের সন্ন্যাসী ফাহাই মনে করেন পাইনিয়ানচি মানুষ নয় , তাই স্থানীয় অধিবাসিদেরদুঃখ ডেকে আনবে । তাই ফাহাই গোপনে সুনিয়েনকে জানালেন যে পাইনিয়ানচি মানুষ নয় , শ্বেত সাপ থেকে পরিণত হয়েছে । সুসিয়েন একথা বিশ্বাস করেন না । ফাহাই সুসিয়েনকে বলেন , চান্দ্রবর্ষের পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিনতুয়ান উ উত্সব । এইদিন স্থানীয় অধিবাসীদের সুনহুয়ান মদ খাওয়ার রীতি আছে । ফাহাই সুসিয়েনকে বলেন , তুমি জোর করে পাইনিয়ানচিকে এই মদ খেতে বলবে , পাইনিয়ানচি এই মদ খেয়ে আসল রূপ দেখাবে । উত্সবের দিন সুসিয়েন স্ত্রী পাইনিয়ানচিকে সুনহুয়ান মদ খেতে জেদ ধরেন । এই সময় পাইনিয়ানচি ইতিমধ্যে গর্ভবর্তী হয়েছেন । স্বামীর বার বার অনুরোধে পাইনিয়ানচি মদ খেয়ে ফেলেন । মদ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইনিয়ানচি একটি শ্বেতসাপে পরিণত হলেন । নিজের স্ত্রীসাপে পরিণত হয়েছে দেখে সুসিয়েন ভয়ে প্রাণ হারালো । স্বামীকে বাঁচানোর জন্য পাইনিয়ানচি হাজারকিলোমিটার দূরের কুলুন পাহাড়েলিংচি ঘাস চুরি করতে গেলেন । সেখানে পাইনিয়ানচি লিংচি ঘাসের রক্ষীদের সঙ্গে লড়াই করা শেষে রক্ষীরাও পাইনিয়ানচির সাহস ও বীরত্বের জন্য মুগ্ধ হলো , তারা লিংচি ঘাস পাইনিয়ানচিকে উপহার দিলো । এই লিংচি ঘাস মরা মানুষকে আবার জীবীত করতে পারে । সুসিয়েন এই যাদু ঘাস খেয়ে জ্ঞান ফিরে আবার জীবিত হলেন । সুসিয়ান যখন জানতে পেরেছেন যে তার স্ত্রী তাকে বাঁচানোর জন্য এতো কষ্ট করে হাজার কিলোমিটার দূরের কুনলুন পাহাড় থেকে এই যাদু ঘাস নিয়েছেন , তখন সুসিয়েনমুগ্ধ হন , তাদের জীবন আগের চেয়ে আরো সুখি হয় । 

  কিন্তু সন্ন্যাসী ফাহাই পাইনিয়ানচিকে বরদাস্ত করতে পারে না । তিনি সুসিয়েনকে চিনসান মন্দিরে নিয়ে তার চুল কেটে সন্ন্যাসী হতে বাধ্য করেন । পাইনিয়ানচি ও সিয়াওছিনরেগে সৈন্যদের নিয়ে চিনসান মন্দিরে ঢুকে সুসিয়েনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন । তারা মন্ত্র পড়ে বন্যার পানি ডেকে চিনসান মন্দিরকে বন্যার পানিতে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন । পাইনিয়ানচিপেটে বাচ্চা আছে বলে সিয়াওছিনের সাহায্যে পালিয়ে গেলেন । তারা যখন ভাঙ্গা সেতুতে পৌছেন , চিনসান মন্দির থেকে পালিয়ে আসা সুসিয়েনের সঙ্গে দেখা করলেন।ভাঙ্গা সেতুতে পাইনিয়ানচির একটি ছেলে হলো । ঠিক এই সময় ফাহাই এসে পড়লো । ফাহাই পাইনিয়ানচিকে পশ্চিম হ্রদের পাশের রেইফোং প্যাগোডার নীচে মেরে ফেলে অভিশাপ দিয়ে বললো , যতোদিন পশ্চিম হ্রদের পানি না শুকায় এবং রেইফোং প্যাগোডা ভেঙ্গে না যায় , ততোদিন পাইনিয়ানচি পৃথিবীতে থাকতে পারবে না ।  

  অনেক বছর পর সিয়াও ছিন আবার পশ্চিম হ্রদে ফিরে যান । তিনি সন্ন্যাসী ফাহাইকে পরাজিত করার পরপশ্চিম হ্রদের পানি চুষেরেইফোং প্যাগোডা ভেঙ্গে পাইনিয়ানচিকে উদ্ধার করলেন ।  

  পাইনিয়ানচি ও সুসিয়েনের পশ্চিম হ্রদে সাক্ষাত ও বিছেদের কাহিনী চীনারা সবাই জানেন । এই কাহিনী হানচৌয়ের পশ্চিম হ্রদকে আরোস্মরনীয় করে তুলেছে ।