উথাই পাহাড়ের কাহিনী


       চীনের বৌদ্ধধর্মের চারটি বিখ্যাত পাহাড় আছে । এই চারটি পাহাড় হলো উথাই পাহাড় , ওমেই পাহাড় , ফুথুও পাহাড় আর চিউহুয়া পাহাড় ।চীনের চারজন বিখ্যাত বোধিসত্ত্বা এই চারটি পাহাড়ে বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চা করেন । এই চারজন বিখ্যাত বোধিসত্ত্বা হলেন ওয়েনসু , ফুসিয়েন , কুয়ানইন ও তিচান । কাজেই এই চারটি পাহাড় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত , এই চারটি পাহাড় চীনের চারটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানও বটে । 

  মধ্য চীনের সানসি প্রদেশে অবস্থিত উথাই পাহাড়ে পাঁচটি শৃঙ্গ আছে । এই পাঁচটি শৃঙ্গের চূড়া খাড়ানয় , যেনমাটির তৈরি পাঁচটি মাচা । এই পাঁচটি মাচার নাম দেওয়া হয়েছে পূর্ব মাচা , পশ্চিম মাচা , দক্ষিণ মাচা , উত্তর মাচা আর মধ্য মাচা । চীনা ভাষায় মাচার উচ্চারণ থাই , পাঁচের উচ্চারণ উ , তাই এই পাহাড়ের নাম দেয়া হয়েছে উথাই পাহাড় । উথাই পাহাড় উত্তর চীনেরসবচেয়ে উচু পাহাড়।  

  চীনের প্রাচীন পুথিপত্রে বলা হয়েছে , উথাই পাহাড়ের আসল নাম উফোং পাহাড় , অর্থাত পাঁচটি শৃঙ্গের পাহাড় । সেখানকার আবহাওয়া ভালো নয়।শীতকালে প্রচন্ড শীত , বসন্তকালে প্রবল বাতাসে সর্বত্রই বালুঝড় হয় আর গ্রীষ্মকালে গরম বেশি । কৃষকরা এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় চাষ করতে পারতেন না । বোধিসত্ত্বা ওয়েনসু বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য উথাই পাহাড়ে পৌছেন । তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের দুঃখদুর্দশা দেখে সেখানকার আবহাওয়া পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন । 

  বোধিসত্ত্বা ওয়েনসু শুনেছেন পূর্বসাগরের ড্রাগন রাজার হাতে ‘ সিয়েলুন পাথর ’ নামে এক যাদু পাথর আছে । এই পাথর আশেপাশের আবহাওয়ায় আদ্রতা নিয়ে আসতে পারে । তাই বোধিসত্ত্বা ওয়েনসুনিজেকে এক সন্ন্যাসীতে পরিণত করে ড্রাগন রাজার কাছেসিয়েলুন পাথর ধার করতে গেলেন। 

  বোধিসত্ত্বা ওয়েনসু পূর্বসাগরে পৌছে ড্রাগন প্রাসাদের বাইরে সত্যি একটি বড় পাথর দেখতে পেলেন । পাথরের কাছে যাওয়ার আগেইওয়েনসু পাথর থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাস অনুভব করেন । তিনি ড্রাগন রাজাকে সিয়েলুন পাথর ধার দেওয়ার অনুরোধ জানালেন । ড্রাগন রাজা বললেন , আপনি অন্য জিনিস চাইলে আমি দিতে পারি । কিন্তু এই সিয়েলুন পাথরধার দিতে পারবো না । কেননা সমুদ্রের তলদেশ থেকে এই পাথর তুলতে কয়েক শ’ বছর লেগেছিলো । এই পাথর খুব ঠান্ডা , আমার ছেলেরা প্রতিদিন বাইরে কাজ করেন , বাড়ী ফিরে এলে প্রচন্ড গরমেঘামে তাদের গায়ের কাপড় ভিজে যায় । শরীর ঠান্ডা করার জন্য তারা প্রায়ই এই পাথরের উপর শুয়ে বিশ্রাম নেয় ।তোমাকে এই পাথর ধার দিলে তারা আর এই পাথরের উপর বিশ্রাম নিতে পারবে না । ওয়েনসু বার বার জানালেন তিনি উফোংপাহাড়ের সন্ন্যাসী , স্থানীয় অধিবাসিদের কল্যানের জন্য তিনি এই পাথর ধার নেওয়ার জন্য এসেছেন । 

  ড্রাগন রাজা আসলে এই যাদু পাথর ধার দিতে চান না , কিন্তু অন্য দিকে বোধিসত্ত্বা ওয়েনসুর প্রার্থনাও প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না । তিনি অনুমান করলেন এই বুড়ো সন্ন্যাসী একা এই পাথর বয়ে নিতে পারবেন না , তাই ড্রাগন রাজা বলেন , এই যাদু পাথর বেশ ভারী , তোমাকে সাহায্য করার কোনো লোক নেই , তুমি যদি একা এই পাথর নিয়ে যেতে পারো , তাহলে নিয়ে যাও ।

  বোধিসত্ত্বা ওয়েনসু ড্রাগন রাজাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যাদু পাথরের কাছে গেলেন । তিনি মন্ত্র পড়তে শুরু করেন , সঙ্গে সঙ্গে এই বড় পাথর মুহুর্তের মধ্যে এক ছোট বলে পরিণত হয় । ওয়েনসু এই ছোট বল পকেটে পুরে চলে গেলেন । পাশে দাঁড়ানো ড্রাগন রাজা ওয়েনসুর এই কান্ড দেখে অবাক হলেন । তিনি পাথর ধার দেয়ার কথা মনে করে আপশোস করতে লাগলেন ।  

  বোধিসত্ত্বা ওয়েনসু যখন উফোং পাহাড়ে ফিরে এলেন , সেসময় দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ার ফলে প্রচন্ড রোদে মাটিতে ফাটল ধরেছে , অধিবাসিরা খরায় জর্জরিত।উনসুসিয়ে লুন পাথর উফোং পাহাড়ের মাঝখানে রাখার সঙ্গে সঙ্গেআশ্চর্য দৃশ্যের সৃষ্টি হলো ।উফোং পাহাড় এক আরামদায়ক পশুপালন এলাকায় পরিণত হলো । স্থানীয় অধিবাসিরা এই পাঁচ শৃঙ্গ পাহাড়কে ছিংলিয়ান পাহাড়নাম দিলেন এবং পাহাড়ের পাশে ছিংলিয়ান নামে একটি মন্দির নির্মান করেন । পরে স্থানীয় অধিবাসিরা উফোং পাহাড়কেও ছিংলিয়ান পাহাড় নামে ডাকতে শুরু করেন । তাই উথাই পাহাড়ের অন্য নাম হলো ছিংলিয়ান পাহাড় । 

   উথাই পাহাড় হলো চীনের জাতীয় পর্যায়ের দর্শনীয় স্থান । উথাই পাহাড় অঞ্চলে মোট ৪২টি বৌদ্ধ মন্দির আছে । এইসব মন্দিরের মধ্যে নানছান মন্দির ও ফোকুয়ান মন্দির বারো শ’ বছর আগে চীনের থান রাজবংশের সময় নির্মিত হয়েছিল । এই দুটি মন্দির হলো এখনো অক্ষতভাবে বজায় রাখা চীনের সবচেয়ে পুরাতন কাঠের তৈরি স্থাপত্য । এইসব মন্দির থেকে প্রাচীন চীনের বৌদ্ধধর্মেরপ্রসার ও প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে । 

  জাতীয় পর্যায়ের দর্শনীয় স্থান হিসেবে উথাই পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যও সুন্দর। এই পাহাড়ের পাঁচটি মাচারে নানা আকারের পাথর ও ঝরনার পানি দেখার মতো। পাহাড়ে প্রচুর গাছ আছে , পাহাড়ের চূড়ায় সারা বছর বরফে আচ্ছাদিত থাকে । তাই গরমকালেও উথাই পাহাড় অঞ্চল আরামদায়ক , গ্রীস্মকালেপর্যটকরা উথাই পাহাড়ে যেতে পছন্দ করেন ।