পন্ডিতমুর্খ তুংকো ও চুংসান নেকড়ের কাহিনী


       ‘ এক হাজার এক রাত ’ নামে আরবী উপকথায় মাঝি ও রাক্ষসের কাহিনী পৃথিবীতে বহুল প্রচারিত হয়েছে । আসলে চীনেও এই ধরনের একটি কাহিনী আছে । এই কাহিনী হলো পন্ডিতমুর্খ তুংকো ও নেকড়ের কাহিনী ।  

  ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চীনের মিং রাজবংশের আমলে মা চুন সির লেখা ‘ তুংথিয়েনচুয়ান ’ নামে একটি বইতে এই কাহিনী আছে । কাহিনীতে বলা হয়েছে , তুংকো নামে এক পন্ডিত ছিলো , তিনি সারাদিন শুধু বই পড়েন , পৃথিবী ও জীবনের অন্য ব্যাপারে কিছুই জানেন না । একদিন তুংকো একটি গাধার পিঠের উপর এক বই ভরা থলি রেখে চাকরীর জন্য চুনসানকো নামে এক জায়গায় যাচ্ছিলেন । হঠাত এক আহত নেকড়ে তার সামনে এসে তাকে মিনতি করে বলে, পন্ডিত মশাই , একজন শিকারী তীর ছুড়ে আমাকে আহত করেছে , শিকারী এখন আমার পিছু ধাওয়া করছে । আপনি দয়া করে আমাকে আপনার থলির ভিতরে লুকিয়ে রাখুন , পরে আমি আপনার উপকার পরিশোধ করবো । পন্ডিত তুংকো অবশ্য জানেন নেকড়ে মানুষ খায় , কিন্তু সামনের এই নেকড়ে আহত হয়েছে , তাকে না বাচাঁলে হয়তো নেকড়ে শিকারীর হাতে খতম হবে । এই কথা ভেবে পন্ডিত তুংকো নেকড়েকে বলেন , আমি জানি তোমাকে বাচাঁলে শিকারী অবশ্যই রাগ করবে , তবে যেহেতু তুমি আমাকে প্রার্থণা করছো , তাই আমি তোমাকে বাচাঁনোর চেষ্টা করবো । এই কথা বলে তুংকো নেকড়কে তার চার পা গুটিয়ে রাখতে বলেন , তারপর তুংকো দড়ি দিয়ে নেকড়ের পা বেঁধে তাকে বইয়ের থলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন ।  

  কিছুক্ষণ পর শিকারী এসে পড়লো । নেকড়েকে না দেখে শিকারী তুংকোকে জিজ্ঞেস করেন , আপনি কি একটি নেকড়ে দেখেছেন ? ও কোন দিকে গেলো ? তুংকো উওরে বললেন , আমি কোনো নেকড়ে দেখি নি , এখানে অনেক শাখা পথ আছে , নেকড়ে হয়তো অন্য পথ দিয়ে পালিয়েছে । শিকারী তুংকোর কথা শুনে অন্য পথ দিয়ে পিছু ধাওয়া করতে গেলো । শিকারী চলে গেছে শুনে থলিতে গুটিয়ে থাকা নেকড়েটি তুংকোকে বলেন , আপনি দয়া আমাকে ছেড়ে দেন । দয়ালু তুংকো নেকড়ের কথা শুনে নেকড়েকে বইয়ের থলি থেকে ছেড়ে দিলেন । কিন্তু নেকড়ে থলি থেকে বেরিয়ে পন্ডিত তুংকোকে বলেন , আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন , কিন্তু এখন আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে , আপনি আরেকবার আমাকে সাহায্য করুন , আমি আপনাকে খেতে চাই । এই কথা বলে নেকড়ে পন্ডিত তুংকোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । 

  পন্ডিত তুংকো নেকড়ের কথা শুনে ভীষন রাগ হললেন । তিনি নেকড়ের সঙ্গেলড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বার বার তাকে বিবেকহীন বলে বকেন । ঠিক এই সময় এক কৃষক কাঁধে কোদাল নিয়ে পার হচ্ছিলেন । পন্ডিত তুংকোকৃষককে তার নেকড়েকে বাঁচানোর কথা বর্ণনা করেন , কিন্তু পাশের নেকড়ে অস্বীকার করে যে তুংকো তাকে বাঁচিয়েছেন । কৃষকটি তাদের দুপক্ষের কথা শুনে বললো , তোমাদের দু জনের কথাই আমি বিশ্বাস করি না , বই রাখার থলি এতো ছোট , কি করে এতো বড় একটা নেকড়ে থলিতে ঢোকানো যায় ? নেকড়ে , তুমি কি আবার থলির মধ্যে ঢুকতে পার ? আমি স্বচোখে দেখতে চাই এতো ছোট থলিতে কিভাবে এতো বড় নেকড়ে রাখা যায় । নেকড়ে রাজি হলো । নেকড়ে মাটিতে শুয়ে চারপা গুটিয়ে দিলো । পন্ডিত তুংকো আবার দড়ি দিয়ে নেকড়ের চারপা বেঁধে দিয়ে থলিতে ঢুকিয়ে দিলেন । এই সময় কৃষক দ্রুত থলির মাথা দড়ি দিয়ে বেঁধে তুংকোকে বললো , আপনি মনে রাখবেন , নেকড়ের মতো পশু কখনো তাদের প্রকৃতি পরিবর্তন করে না । কিন্তু আপনি নেকড়েকে দয়া দেয়ালেন , আপনি সত্যই এক পন্ডিতমুর্খ । এই কথা বলে কৃষকটি কাঁধের কোদাল উঠিয়ে থলির ভিতরের নেকড়ে মেরে ফেললো ।  

  এই সময় পন্ডিত তুংকো বুঝতে পেরেছেন যে বুদ্ধিমান কৃষক তাকে বাঁচালেন। এখন পন্ডিত তুংকো ও চুনসান নেকড়ে চীনা ভাষায় বিশেষ অর্থবহনকারী শব্দে পরিণত হয়েছে । পন্ডিত তুংকো হলো উচিত ও অনুচিত নির্ণয় না করে সবাইকে সহানুভুতি জানানো ব্যক্তি আর চুনসান নেকড়ে হলো বিবেকহীন ব্যক্তির প্রতীক ।