লাওসান দেবতার কাহিনী


       ‘লিয়াওচাইইচি’ প্রাচীন চীনের একটি বিখ্যাত ভূতের কাহিনীর বই । এই বইয়ের সব কাহিনী যেমন অদ্ভুত , তেমনি শিক্ষনীয় । ‘লাওসান দেবতা’তার মধ্যে একটি ।  

  কাহিনীতে বলা হয়েছে , সমুদ্রের পাশে লাও পাহাড়ে এক দেবতা থাকেন। সবাই তাকে লাওসান তাওসি ডাকেন । তিনি অনেক জাদুবিদ্যা জানেন। লাও পাহাড়ের কয়েক শ’কিলোমিটার দূরের জেলা শহরে ওয়াং ছি নামে এক ব্যক্তি ছোট বেলা থেকেইজাদুবিদ্যা শিখতে পছন্দ করে । লাওসান তাওসি জাদুবিদ্যাজানেন শুনে ওয়াংছিতার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । লাও পাহাড়ে পৌছে ওয়াং ছি ও লাওসান তাওসিরদেখা হলো । আলাপের সময় ওয়াংছি লাওসান তাওসির শিক্ষানবীস হওয়ার অনুরোধ জানালেন । লাওসান তাওসি ওয়াংছিকে আগাপাছতলা দেখেবললেন , তুমি বাড়ীতে সব সময় আরামে দিন কাটাও , তুমি কষ্ট ভোগ করতে পারবে না।ওয়াংছির বার বার অনুরোধে লাওসানতাওসি ওয়াংছিকে তার শিক্ষানবিস হিসেবে গ্রহণ করতে রাজী হলেন । 

  সেইদিন রাতেজানালার বাইরের চাঁদের প্রতি তাকিয়ে শীঘ্রই জাদুবিদ্যা শিখতে পারেন বলে ওয়াংছি আনন্দ বোধ করেন । কিন্তু পরদিন ভোর বেলায় তার শিক্ষক তাকে জাদুবিদ্যা তো শিখান নি , বরংতার হাতে এক কুঠার দিয়ে অন্য ছাত্রের সঙ্গে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে যেতে বলেন । ওয়াংছি মনে আপত্তি করলেও মুখে কিছু বলে নি । পাহাড়ে জ্বালানীর কাঠ সংগ্রহের কাজ ওয়াংছি কখনও করে নি , তাই সূর্য নামার আগেই তার হাত ও পায়ে অনেক রক্ত ফোসকাপড়েছে।  

  একমাস পর ওয়াংছির হাত ও পায়ের ফোসকা ধীরে ধীরে জুতার ঘষাতে শক্ত কড়ায়পরিণত হলো । ওয়াংছি আর সারাদিন কাঠ সংগ্রহের কষ্ট সহ্য করতে চায় না। তাই বাড়ী ফেরার কথা চিন্তা করতে শুরু করে । সেদিন সন্ধ্যায় ওয়াংছি ও অন্যান্য ছাত্র বাসায় ফিরে দেখলো তাদের শিক্ষক দুজন অতিথির সঙ্গে মদ খেতে খেতে আলাপ করছেন । তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো , ঘরে বাতি জ্বালানো হয়নি । ওয়াংছি দেখেছে তার শিক্ষক একটি কাগজগোল চাঁদের মতো কেটে দেওয়ালে এটেঁ দিলেই কাগজের চাঁদ থেকে আলো বের হতে শুরু করে , ঘরটি তত্ক্ষনাত্ই আলোকিত হয় । এই সময় এক অতিথি বলেন , এই মনোরম রাতে আমাদেরএক সঙ্গে আনন্দে কাটানো উচিত । লাওসান তাওসি এক বোতল মদ তার ছাত্রদের হাতে দিয়ে তাদের যা ইচ্ছা তা খাওয়ারকথা বলেন । পাশে বসা ওয়াং ছি শিক্ষকের এই কথা শুনে ভাবতে লাগলো , এক বোতল মদ আমরা কি করে যা ইচ্ছা তা পান করতে পারবো? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই মদের বোতল সবার বাটি পূর্ণ করার পরও মদ কমে না । কিছুক্ষণ পর আরেকজন অতিথি লাওসান তাওসিকে বলেন , ঘরের মধ্যে চাঁদের আলোতে মদ খাওয়া আনন্দের ব্যাপার । তবে যদি মদ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাচ দেখতে পারি , তাহলে কতো ভালো হতো।এই কথা শুনে লাওসান তাওসি টেবিলের একটি খাবার কাঠি হাতে নিয়ে দেওয়ালে আঁটা সাদা কাগজের স্পর্শ করলেইচাঁদের আলো থেকে এক এক- ফুট লম্বা মেয়ে বেরিয়ে এলো। মেয়েটি ঘরের মাটিতে দাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত বড় হয়ে সাধারণ মেয়ে হয়েছে । এই মেয়ে দেখতে ফর্সা ও সুন্দর । মেয়েটি নাচতে নাচতে গান করতে শুরু করেন , একটি গান শেষ করার পর মেয়েটি ঝাঁপ দিয়ে টেবিলে উঠে , উপস্থিত সবাই চমকে উঠলো । কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে মেয়েটি আবার একটি খাবার কাঠিতে পরিণত হলো । এইসব দেখে ওয়াং ছি সত্যিই অবাক হলো । এই সময় এক অতিথি বলেন , আজ আমি খুব খুশি , আমাকে এখন ফিরে যেতে হবে । এই কথা বলে লাওসান তাওসি ও দুজন অতিথি খাবার টেবিলটি দেওয়ালে চাঁদে নিয়ে গেল । চাঁদের আলো ধীরে ধীরে কমে যায় । ছাত্ররা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে দেখল , তাদের শিক্ষক লাওসানতাওসি একাই বসে আছেন । অতিথিরা অদৃশ্য হলো , বাকী মদ ও তরকারীগুলো টেবিলে আছে । 

  আরো এক মাস পার হলো । শিক্ষক লাওসানতাওসি ছাত্রদের জাদুবিদ্যা শিখান না দেখে ওয়াংছি অার সহ্য করতে পারেনা । সে লাওসানতাওসিকে বললো , আপনার কাছ থেকে জাদু বিদ্যা শেখার জন্য আমি দূর থেকে এখানে এসেছি । কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই শিখিনি । আপনি যদি অমরত্বের মতো বড় বড় জাদু আমাকে না শেখান , তাহলে দয়াকরে ছোটখাটো দু-একটা জাদু আমাকে শিখাবেন , কেমন ? কিন্তু শিক্ষক লাওসানতাওসি শুধু হাসেন , কিছু বলেন না । ওয়াংছি আবার বললো , আমি প্রতিদিন পাহাড়ে উঠে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করি , বাসায় থাকার সময় আমি কোনোদিন এই কষ্ট করি নি । লাওসানতাওসি হেসে বললেন , আমি প্রথম দিকেই জানি তুমি কষ্ট সহ্য করতে পারবে না , আচ্ছা , কাল সকালে তুমি বাড়ী ফিরে যাও । ওয়াংছি প্রার্থণা করে বলে , আমি খালি হাতে ফিরে যেতে চাই না , আপনি ছোট একটা জাদু আমাকে শেখান । লাওসানতাওসি ওয়াংছিকে জিজ্ঞেস করেন , তুমি কি জাদু শিখতে চাও ? ওয়াংছি বললো , আমি দেখেছি আপনি পথে হাটার সময় কোনো দেওয়াল আপনাকে বাধা দিতে পারে না , আপনি আমাকে দেওয়ালে ঢোকার জাদু আমাকে শেখান । লাওসানতাওসি রাজী হলেন । এক দেওয়ালের সামনে গিয়ে লাওসানতাওসি দেওয়ালে ঢোকার মন্ত্র ওয়াংছিকে শিক্ষিয়ে তাকে এই মন্ত্র পড়ার নির্দেশ দিলেন । ওয়াংছি এই মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাওসানতাওসি তাকে দেওয়ালে ঢোকার আদেশ দিলেন । ওয়াংছি কিন্তু ঢোকার সাহস পায় না এবং কাঁপতে শুরু করে । লাওসানতাওসি আবার বলেন , ঢোকার চেষ্টা করো । ওয়াংছি কয়েক পদক্ষেপ এগিয়ে যাওয়ার পর আবার থামে। লাওসানতাওসি ভ্রুকুঁচে বলেন , মাথা নীচু করে সামনে যাও । এবার ওয়াংছি সামনে দৌড় দিতে শুরু করে । নিজের অজান্তে ওয়াংছি দেওয়ালের ওপারে এসে পড়লো । ওয়াংছি মহাখুশি , সে লাওসানতাওসিকে বার বার ধন্যবাদ জানালো । লাওসানতাওসি তাকে বললেন , তুমি বাড়ী ফিরে গিয়ে ভালো করে পরিশ্রম করবে , নাহলে তোমার শেখা জাদু সফল হবে না । 

  ওয়াংছি বাড়ী ফিরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বললো , আমি দেবতার কাছ থেকে জাদু শিখেছি , এখন দেওয়াল আমাকে বাধা দিতে পারে না । তার স্ত্রী তার কথা বিশ্বাস না করে বলেন , পৃথিবীতে কি এই ধরনের অদ্ভুত ব্যাপার আছে ? ওয়াংছি স্ত্রীকে তার শেখা জাদু দেখানোর জন্য মুখে মন্ত্র পড়তে পড়তে দেওয়ালের দিকে দৌড়তে লাগলো । তার মাথা দেওয়ালে লেগে ওয়াংছি মাটিতে পড়লো , তার স্ত্রীর সাহায্যে ওয়াংছি উঠে দেখলো আঘাত খেয়ে তার কপাল ফুলেছে । ওয়াংছি একেবার হতাশ হয়ে পড়লো । তার স্ত্রী তাকে বললো , পৃথিবীতেএই ধরনের জাদুবিদ্যা থাকলেও তোমার মতো তিন মাসে আয়ও করা সম্ভব নয় । ওয়াংছি ভাবলো , সেদিন রাতে আমি সত্যিই মন্ত্র পড়ে দেওয়ালের ভিতরে ঢুকেছি , কেন বাসায় ফিরে ব্যর্থহলাম?তিনি সন্দেহ করেন লাওসানতাওসি তাকে ঠকিয়েছে , তাই ওয়াংছি লাওসেনতাওসিকে গালি দিতে লাগলো । ওয়াংছি আগের মতো এক অবিদিত ও অসমর্থ লোক হয়ে রইলো ।