ছানউওর চাঁদে উঠার কাহিনী


       চীনের চান্দ্র বর্ষের অষ্টম মাসের পঞ্চদশ দিন হচ্ছে চীনাদের মধ্য সরত্ দিবস । চীনে বসন্ত উত্সব , তুয়ান উ উত্সব ও মধ্য সরত্ উত্সব হচ্ছে চীনের তিনটি সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় ঐতিহ্যিক উত্সব । মধ্য শরত উত্সবে চীনে পরিবারের সবাই একসঙ্গে মনকেক ও ফলমুল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের পূর্ণিমা উপভোগ করার রেওয়াজ আছে । ছানউওর চাঁদে উঠার কাহিনী এই মধ্য শরত উত্সবের সঙ্গে সম্পর্কিত ।  

  ছানউও আকাশের চাঁদ-দেবী , তার স্বামী হৌই এক বীর । তিনি কোনো দিন ফাঁকা তীর ছুড়েন না । এক সময় পৃথিবীতে হিংস্র পশুর উপদ্রবে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারছিলো না । স্বর্গীয় রাজা এই খবর পেয়ে হৌইকে এইসব পশু নিশ্চিহৃ করার আদেশ দিলেন । হৌই রাজার আদেশ পেয়ে সুন্দর স্ত্রী ছানউওকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আসেন । তিনি বীরত্বের সঙ্গে পৃথিবীর প্রচুর হিংস্র পশু হত্যা করেন । যখন হৌই আকাশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন , ঠিক এই সময় আকাশে দশটি সুর্য্য দেখা দিলো । দশটি সুর্য্যই স্বর্গীয় রাজার ছেলে । মজার জন্য তারা একসঙ্গে আকাশে উঠলো । আকাশে দশটি সুর্য্য থাকে বলে মাটিতে তাপ দ্রুত বাড়ে , বন অঞ্চল ও চাষজমির শস্য শুকিয়ে আগুন ধরে , নদীর পানি শুকিয়ে যায় , প্রচুর মানুষ আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন । 

হৌই পৃথিবীর মানুষের এই দুদর্শা সহ্য করতে পারেন না । তিনি দশটি সুর্য্যকে পালাক্রমে বের হওয়ার পরামর্শ দেন । একদিন শুধু একটি সুর্য্য বের হবে। কিন্তু সুর্য্যগুলো হৌইর কথা তো শুনে না , উপরন্তু মাটির আরো কাছে আসে । ফলে পৃথিবীতে সর্বত্রই আগুন জ্বলে , অসংখ্য মানুষ আগুনে প্রাণ হারায় । এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হৌই তার ধনুক দিয়ে আকাশের সুর্য্য লক্ষ্য করে তীর ছুড়লেন , তিনি পর পর নয়টি সুর্য্য নামিয়ে দিলেন । শেষ সুর্য্য তার কাছে ক্ষমা চাইছে দেখে হৌই তাকে ছেড়ে দিলেন।  

হৌই পৃথিবীর মানুষকে দুঃখদুর্দশা থেকে বাঁচালেন । কিন্তু হৌই নিজের নয়টি ছেলে মেরে ফেলেছেন বলে স্বর্গীয় রাজা খুব রাগ করলেন । স্বর্গীয় রাজা হৌই ও তার স্ত্রীকে আকাশে ফিরে যেতে নিষেধ করেন । আকাশে ফিরে যেতে না পেরে হৌই পৃথিবীর মানুষের জন্য আরো বেশী ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী ছানউও পৃথিবীর কষ্টকর জীবনের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং স্বর্গীর রাজার ছেলে হত্যা করার জন্য হৌইকে বকা দেন । 

  হৌই শুনেছেন কুনলুন পাহাড়ে থাকা সিওয়ানমু নামে এক দেবীর হাতে আকাশে উঠার ওষুধ আছে । তাই হৌই পাহাড় ডিঙিয়ে নদী অতিক্রম করে কুনলুন পাহাড়ে উঠলেন । তিনি সিওয়ানমু দেবীর কাছে এই ওষুধ পাওয়া অনুরোধ জানালেন । দেবীর হাতের ওষুধ কম , মাত্র একজনের জন্য যথেষ্ঠ । হৌই স্ত্রীকে রেখে একা আকাশে উঠতে চান না । তিনি এটাও চান না যে স্ত্রী তাকে পৃথিবীতে রেখে একা ওষুধ খেয়ে আকাশে চলে যায় । তাই হৌই এই ওষুধ বাসায় লুকিয়ে রাখলেন । 

হৌইর যাদু ওষুধ পাওয়ার কথা ছানউও পরিশেষে জানতে পারলেন । যদিও ছানউও নিজের স্বামীকে ভালোবাসেন , তবে আকাশের সুখী জীবনের প্রলোভনে ছানউও মধ্য শরত উত্সবের দিন হৌইর লুকানো ওষুধ খেয়ে ফেলেন । ওষুধ খেয়ে তার শরীর ক্রমেই হালকা হচ্ছে । ছানউও ধীরে ধীরে উপরে উড়তে শুরু করেন এবং চাঁদের কুয়ানহান ভবনে পৌছেন । বাড়ী ফিরে স্ত্রী যাদু ওষুধ খেয়ে তাকে ফেলে দিয়ে একা আকাশে চলে গেছেন দেখে হৌই অত্যন্ত দুঃখ পান। কিন্তু হৌই নিজের স্ত্রীকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়েন নি । 

  হৌই অব্যাহতভাবে পৃথিবীর মানুষকে সাহায্য করেন এবং তাদের তীর ছুড়তে শেখান । তার ছাত্রদের মধ্যে ফোংমেং নামে এক যুবকের বুদ্ধি বেশী , অল্প দিনের মধ্যেই তিনি একজন দক্ষ তীরন্দাজ হলেন । ফোংমেং মনে করে যতোদিন হৌই জীবিত থাকেন , ততো দিন তিনি পৃথিবীর এক নম্বর তীরন্দাজ হতে পারবেন না। তাই একদিন মদ খাওয়ার সময় ফোংমেং পিছন থেকে তীর ছুড়ে হৌইকে হত্যা করে । 

  ছানউও চাঁদে উঠে নিঃসঙ্গ মনে করেন । তার পাশে শুধু একটি ওষুধ গুড়া করার খড়গোস ও এক কাঠুরিয়া থাকে । চাঁদের সুন্দর ভবনে থাকলেও ছানউওর মন খারাপ । বিশেষ করে প্রতি বছরের অষ্টম মাসের পঞ্চদশ দিনের মধ্য শরত উত্সবে হৌইর সঙ্গে তাদের সুখী জীবনের কথা স্মরণ করে ছানউওর মনে বেদনায় ভরে উঠে ।