ছিইউ ও হুয়ান তির লড়াই


       কয়েক হাজার বছর আগে চীনের হলুদ নদী ও ইয়াংসি নদীর অববাহিকা অঞ্চলে অনেক উপজাতি বাস করতো । হুয়ান তিন হলেন হলুদ নদীর অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থান করা সবচেয়ে বিখ্যাত উপজাতির সর্দার । অন্য একটি উপজাতির সর্দারের নাম ইয়েনতি । হুয়ানতি ও ইয়েনতি পরস্পরের বন্ধু ও ভাই । ইয়াংসি নদীর অববাহিকা অঞ্চলে চিউলি নামে একটি উপজাতি ছিলো , এই উপজাতির সর্দারের নাম ছিইউ , এই উপজাতি এক শক্তিশালী উপজাতি । 

  ছিইউর ৮১টি ভাই ছিলো । তাদের মুখ মানুষের , কিন্তু শরীর ছিলো পশুর মতো । এই উপজাতির লোক তলোয়ার ও তীর-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্র নিপুণভাবে তৈরী করতো । সর্দার ছিইউ প্রায়ই তার ভাইদের নিয়ে অন্য উপজাতির বিরুদ্ধে আক্রমন করতো । 

  একবার ছিইউ ও তার ভাইরা ইয়েনতির জায়গা দখল করলো । ইয়েনতি সৈন্যদের নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন । কিন্তু ইয়েনতির সৈন্যরা ছিইউর সৈন্যদের মতো শক্তিশালী ছিলো না । তাই অল্প দিন পরই পরাজয় বরণ করে । ইয়েনতি কোনো উপায় না দেখে সাহায্যের জন্য হুয়াংতির কাছে গেলেন। হুয়াংতি অনেক আগে থেকেই চাইছিলেন ছিইউকে নিশ্চিহৃ করতে। তাই আশেপাশের উপজাতিদের সঙ্গে চুলু নামে একটি জায়গায় ছিইউর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন ।  

  প্রথম দিকে ছিইউর সৈন্যরা তাদের তৈরী অস্ত্র ব্যবহার করে বিজয় লাভ করলো । পরে হুয়াংতি ড্রাগন ও অন্যান্য পশুদের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানান । যদিও ছিইউর সৈন্যবাহিনী শক্তিশালী , তবে হুয়াংতির বাহিনী ও হিংস্র পশুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পেরে পালিয়ে গেলো ।  

  হুয়াংতির বাহিনী ছিইউর বাহিনী ধাওয়া করতে লাগলো । হঠাত্ অন্ধকার ঘনিয়ে আসলো । প্রবল বাতাস বইতে শুরু করো । বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুশলধারে বৃষ্টি হলো । এই প্রতিকুল আবহাওয়ায় হুয়াংতির সৈন্যরা আর পিছু ধাওয়া করতে পারলো না । ছিইউ বাতাস দেবতা ও বৃষ্টি দেবতাকে সাহায্যের অনুরোধ জানাল । হুয়াংতি এই অবস্থা দেখে স্বর্গের খরা দেবতাকে সাহায্যের অনুরোধ জানালেন । খরা দেবতার সাহায্যে মুহুর্তের মধ্যে প্রবল বাতাস ও ঝড়বৃষ্টি থেমে সুর্য উঠলো ।  

  এই সময় ছিইউ আবার মন্ত্র পড়ে কুয়ানা সৃষ্টি করলো । ঘন কুয়াসায় হুয়াংতির সৈন্যরা দিক-নিণর্য় করতে না পেরে অগ্রসর হতে পারলো না । এই সময় হুয়াংতি একটি উপায় খুঁজে বের করেন । আকাশের সাত তারকাবিশিষ্ট তারকামন্ডলী সপ্তর্ষি সবসময় উত্তর দিকে থাকে বলে হুয়াংতি একটি দিকনির্নয় গাড়ী তৈরী করে ঘণ কুয়াসার মধ্যে সৈন্যদের পরিচালনা করেন । 

  বহুবার প্রচন্ড লড়াইয়ের পর হুয়াংতি ছিইউর ৮১জন ভাইকে হত্যা করেন এবং ছিইউকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরেন । হুয়াংতি ছিইউকে বেঁধে হত্যা করার পর তার মাথা ও শরীর দুটি জায়গায় সমাধিস্থ করেন , ছিইউকে বাধাঁর দড়িগুলো পাহাড়ে ছুড়ে দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে ওই পাহাড়ে প্রচুর মেইপল গাছ দেখা দিল , এইসব গাছের লাল পাতায় ছিইউর রক্তের চিহৃ দেখা যায় ।  

  ছিইউর মৃত্যুর পরও অনেকে তার হিংস্র মুখ দেখে ভয় পান । হুয়াংতি তার ছবি নিজের সৈন্য বাহিনীর পতাকায় এঁকে দেন । অন্য উপজাতির লোক হুয়াংতির এই পতাকা দেখে ভয়ে হুয়াংতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহস পায় না । ধীরে ধীরে হুয়াংতি অনেক উপজাতির সমর্থন পেয়ে সব উপজাতির সর্দার হলেন ।  

  হুয়াংতি একজন বুদ্ধিমান ও কাজের মানুষ । তিনি অনেক কিছু তৈরী করতে পারতেন । তিনি প্রাসাদ , গাড়ী , নৌকা ও নানান ধরনের জামা-কাপড় তৈরী করতে পারতেন । তার স্ত্রী লোচুও একজন বুদ্ধিমতী নারী । প্রাচীনকালে লোকেরা রেশমপোকা চাষ করতেন না , তারা রেশমগুটির উপকার জানতেন না । লোচু স্থানীয় অধিবাসীদের রেশমগুটি থেকে রেশমী কাপড় তৈরী করতে শেখান । তখন থেকে চীনের তৈরী রেশমী কাপড় ক্রমেই বিখ্যাত হয় । হুয়াংতি পাভিলিয়ন তৈরী করার পর লোচু বৃষ্টির দিনে ব্যবহার করা ভ্রাম্যমান পাভিলিয়ন অর্থাত ছাতা আবিষ্কার করেন ।  

  প্রাচীন চীনের উপকথাগুলোতে হুয়াংতির ভুয়সী প্রশংসা করা হয়েছে । চীনা জাতির উত্তরসুরীরা হুয়াংতিকে তাদের পূর্বপুরুষ মনে করেন । তারা মনে করেন তারা সবই হুয়াংতির নাতি-নাত্নী । ইয়েনতি ও হুয়াংতির ভাই বলে চীনারা নিজেকে ইয়েনতি ও হুয়াংতির উত্তরসুরীও বলেন । রুপকথার এই পূর্বপুরুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য চীনারা হলুদ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত শানসি প্রদেশের হুয়াং লিন জেলার উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ে হুয়াংতির সমাধিস্থল তৈরী করেন । প্রতি বছরের বসস্তকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চীনাদের প্রতিনিধিরা হুয়াংতির সমাধিস্থলে গিয়ে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।