ইয়াও ও সুনের যোগ্য উত্তাধিকারী নির্বাচণের কাহিনী


       চীনের সুদীর্ঘ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ইতিহাসে রাজার মৃত্যুর পর নিয়ম অনুসারে তার ছেলে রাজার আসন গ্রহন করেন । কিন্তু চীনের রুপ কথায় চীনের সবচেয়ে আগেকার তিনজন রাজার উত্তরাধিকার তাদের ছেলে নয় , এই তিনজন রাজা নৈতিকতা ও যোগ্যতা অনুসারে নিজের উত্তরাধিকারী বেছে নিয়েছিলেন । 

  চীনের রুপকথায় ইয়াও হলেন চীনের প্রথম রাজা । তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের একজন উত্তরাধিকারী বেঁছে নেওয়ার চেষ্টা করেন । রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার সর্দারদের মতামত শোনার জন্য তিনি তাদের জড়ো করেন ।  

  ফানজি নামে একজন সর্দার বলেন , আপনার ছেলে তানচু একজন মুক্তমনা মানুষ , তিনি আপনার উত্তরাধিকার হতে পারেন । ইয়াও বলেন , না , আমার ছেলের আচার ব্যবহার ভালো নয় , প্রায়ই অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করে। অন্য একজন সর্দার বলেন , জলপ্রকল্পে কাজকরা কোনকোন একজন ভালো মানুষ । ইয়াও মাথা নেড়ে বলেন , কোনকোন মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন এবং সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন , কিন্তু মনের কথা কখনও বলেন না , এই ধরনের লোককে উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ করলে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো না । আলোচনায় কোনো ফল হয়নি বলে ইয়াও অব্যাহতভাবে তার উত্তরাধিকার নির্বাচণের চেষ্টা করেন ।  

  কিছুদিন পর উত্তরাধিকার নির্বাচণের জন্য ইয়াও আরেকবার বিভিন্ন উপজাতির সর্দারদের ডেকে আনেন । এবার বেশ কয়েকজন সর্দার ইয়াওকে সুন নামে এক যুবকের সুপারিশ করেন । ইয়াও এই কথা শুনে বলেন , হ্যাঁ , আমিও এই ছেলের কথা শুনেছি । আপনারা কি তার গুনাবলী আমাকে বিস্তারিতভাবে বলতে পারেন ? সর্দাররা বলেন , সুনের বাবা এক মোটাবুদ্ধির লোক , সবাই তাকে কুসৌ অথার্ত্ অন্ধ বুড়ো ডাকে । অনেক বছর আগে সুনের মার মৃত্যু হয় , তার সত্ মা সুনকে খুব খারাপ ব্যবহার করেন । সত্ মায়ের ছেলের নাম সিয়ান , সিয়ান বাবাকে শ্রদ্ধা করে না , তবে কুসৌ সিয়ানকে খুব আদর করেন । এই ধরনের এক পরিবারে সুন কিন্তু বাবা , সত্ মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন । তাই সবাই বলেন সুন এক উচ্চ নৈতিকতার মানুষ ।  

  সর্দারদের কথা শুনে ইয়াও সুনকে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেন । তিনি নিজের দুটি মেয়ে ওহুয়ান ও ইংহুয়াংকে সুনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তাকে একটি খাদ্যশস্যের গুদাম ও প্রচুর গরু ও ছাগল উপহার দেন । সুনের সত্ মা ও ভাই এতবেশী উপহার দেখে হিংসা করতে শুরু করেন । তারা কুসৌর সঙ্গে সুনকে হত্যা করার চেষ্টা করে ।  

একদিন কুসৌ সুনকে খাদ্যশস্যের গুদাম মেরামত করতে বলেন । সুন সিড়ি দিয়ে গুদামের উপর উঠার পর সুনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার জন্য কুসৌ গুদামের নীচে আগুন জ্বালিয়ে দিলো । সুন গুদামের উপরে আগুন দেখে সিড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন , কিন্তু সিড়ি অদৃশ্য হলো । সুনের কাছে শুধু সুর্য্যের রোদ ঢাকার দুটি খাগড়ার টুপি ছিলো । তিনি দুই হাত খাগড়ার টুপি নিয়ে পাখির মতো উড়ে মাটিয়তে নামলেন , খাগড়ার টুপির সাহায্যে সুনের কোনো ক্ষতি হয়নি।  

  তার বাবা কুসৌ ও ভাই সিয়ান এতেও ক্ষান্ত হয়নি । তারা সুনকে কুয়ো পরিষ্কার করতে বলেন । সুন কুয়োতে নামার পর তারা দুজন কুয়োতে প্রচুর পাথর ছুড়ে দেয় , তারা সুনকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলতে চায় । কিন্তু সুন কুয়োর নীচে নামার পর পাশে একটি সুড়ঙ্গ পথ খনন করে নিরাপদে বাড়ী ফিরলেন ।  

  সুনের ভাই সিয়ান জানে না যে তার বড় ভাই বিপদমুক্ত হয়ে বাড়ী ফিরেছেন । সিয়ান বাসায় ফিরে কুসৌকে বল্লো , এবার বড় ভাই নিশ্চয়ই মারা গেছে । এই মতলব আমি খুঁজে বের করেছি , তাই তার সব সম্পদ আমার । এই কথা বলে সিয়ান সুনের ঘর ঢুকলো , ঢুকেই সিয়ান অবাক হলো , সিয়ান দেখলো তার বড় ভাই সুন বিছানার পাশে বসে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন । সুনকে দেখে সিয়ান অবাক হলো , হতভম্ব হয়ে সে সুনকে বললো , ও ভাইয়া , আপনার জন্য আমরা খুব চিন্তিত ছিলাম ।  

  সুন শান্তকন্ঠে সিয়ানকে বলেন , তুমি ঠিক সময় এসেছো , আমি তোমার সাহায্য চাই । এই ঘটনার পর সুন আগের মতো তার বাবা-মা ও ভাইয়ের ভালো ব্যবহার করেন । তার বাবা ও ভাইও এরপর আর সুনকে হত্যা করার সাহস পায় না ।  

  ইয়াও সুনকে বারবার পরীক্ষা করে স্থির করলেন যে , সুন সত্যিই একজন উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তি , তাই তিনি রাজার আসন সুনকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । তার এই পদ্ধতিতে রাজার আসন হস্তান্তরকে চীনের ইতিহাসবিদরা ‘সানরান’ বলেন । 

সুন রাজা হওয়ার পর তার পরিশ্রমী ও মিত্যব্যয়ী গুনের কোনো পরিবর্তন হয়নি । তিনি সবার সঙ্গে পরিশ্রমে অংশ নেন , তাই তিনি সবার আস্থা লাভ করেন। সুন রাজা হওয়ার কয়েক বছর পর ইয়াওয়ের মৃত্যু হয় । প্রথম দিকে সুন রাজার আসন ইয়াওয়ের ছেলে তানচুকে দিতে চেয়েছিলেন , কিন্তু অধিবাসীরা রাজী নন । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুন একই উপায়ে ভালো নৈতিকতা ও দক্ষতাসম্পন্ন উয়ুকে নিজের উত্তরাধিকার বেছে নিলেন ।  

  চীনারা মনে করেন , ইয়াও –সুন-ইয়ুর আমলে চীনারা স্বার্থ ও অধিকারের জন্য কেন্দন করেন না , রাজাও সাধারণ মানুষের মতো সাদাসিদা জীবন যাপন করেন ।