মহাকাব্য ‘মানস ’ তিববতী জাতির মহাকাব্য ‘গেসার’ ও মঙ্গোলীয় জাতির মহাকাব্য ‘চিয়াংগের’ থেকে আলাদা । এর প্রধান নায়ক একজনের পরিবর্তে একটি পরিবারের আটটি পুরুষ ।
‘মানস ’ কিরগিজ জাতির বীর প্রশংসার মহাকাব্য । কিরগিজ জাতি চীনের প্রাচীন উপজাতিগুলোর অন্যতম ।এর অধিকাংশ মানুষ থাকেন উত্তর পশ্চিম চীনের সিনচিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ।‘মানস ’ খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দি থেকে দশম শতাব্দি পর্যন্ত সময়পর্বে রচিত হয় । যুগ যুগ ধরে কিরগিজ জাতির প্রতিভাশালী গায়করা তা পরিবেশন ও পরিমার্জন করতে থাকেন । কালক্রমে তাতে মিশে যায় সমগ্র জাতির বিজ্ঞতা । সাহিত্যকর্ম হিসেবে এর জাতীয় বৈশিষ্ট্য স্পষ্টই পরিলক্ষিত। কথিত আছে , কোনো কবি মানসিক প্রেরণা পেয়ে‘মানস ’ লিখেন নি ।স্বপ্নে ঈশ্বর-প্রেরণা পেয়ে একজন গায়ক এই মহাকাব্যের দশ লক্ষ চরণ আবৃত্তি করতে পেরেছেন । এই কথা অবিশ্বাস্য । কিন্তু কিরগিজ জাতির ‘মানস ’ --অনুরাগীরা গভীরভাবে তা বিশ্বাস করেন ।
‘মানস’ কিরগিজ জাতির উপকথার একজন সুখ্যাত বীর ও দলপতি এবং শক্তি, সাহস ও বিজ্ঞতার প্রতীক । ‘মানসের’ পরিবারের আট প্রজন্মের বংশধররা ভিন জাতির শাসকের লুণ্ঠন ও জুলুমের বিরুদ্ধে মুক্তি ও সুখশান্তি অর্জনের সংগ্রামে কিরগিজ জাতির জনসাধারণকে নেতৃত্ব দেন । এইকাব্যের আটটি অধ্যায়ের নাম যথাক্রমে: ‘মানস’ ,‘ সাইতাই ’,‘ সাইতাইক ’, ‘ খাইনাইমু’ , ‘ সাইইত ’ , ‘ আসেলেপাহা ও বেকপাছা’ ,’ ‘ সুমুবিলাইক’ ও ‘ ছিকেতাই ’ । এক এক অধ্যায়ে এক এক প্রজন্মের বীরের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে । তবে আটটা অধ্যায় যোগসূত্রে গ্রথিত, আটটা অধ্যায় নিয়ে গঠিত এই মহাকাব্যের চরণ-সংখ্যা প্রায় দু লক্ষ দশ হাজার এবং শব্দ-সংখ্যা দু’কোটি ।
মহাকাব্য ‘মানস’এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায় চরিত্রাঙ্কন ও পরিমন্ডলের বর্ণনায় । প্রধান নায়ক ‘মানস’ ও তাঁর বংশধর ছাড়া অন্য শতাধিক চরিত্রও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল ।তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছে ‘মানস’ এর বুদ্ধিদীপ্ত বর্ষীয়ান সমর্থক ও ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা তেমনই রয়েছে হিংসুক রাজা কারমক খান ,নির্লজ্জ্ বিশ্বাসঘাতক ও কুকর্মে লিপ্ত দানব । এই মহাকাব্যে বিশ-তিরিশটি যুদ্ধাভিযান বর্ণিত হয়েছে। বীরদের ব্যবহৃত অস্ত্র অজস্র ।তাঁদের বাহকের চামড়ার রঙ ত্রিশাধিক রকমের ।
একটি উপজাতির লোক-মহাকাব্য হিসেবে ‘মানস’এর রচয়িতা ও ধারকদের সংখ্যা দশ সহস্রাধিক । জুসুপু.মামাইয়ের জন্মের পূর্ববর্তী সহস্রাধিক বত্সরে কেউ গোটা ‘মানস’ আবৃত্তি করতে পারত না এবং কোনো লিখিত ভাষায় ‘মানস’ রচিত ছিল না ।
৮৫ বছর বয়সী জুসুপু.মামাইকে জীবিত হোমার বলে আখ্যায়িত করা হয়।তিনি সারা জীবন ‘মানস’এর চরণ সংগ্রহ ও পরিমার্জন এবং সুর বেঁধে গাওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন ।১৯৪০ সাল তিনি টানা সাতদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য ‘মানস’এর গান গেয়েছেন । এরপর তাঁর সুনাম বিস্তীর্ন তৃণভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে ।১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৮খন্ড বিশিষ্ট ‘মানস’ এর যাবতীয় শ্লোকের জন্য সুর বেঁধে তিনি গেয়েছেন এবং লিখিত মহাকাব্য‘মানস’ও প্রকাশ করেছেন । তিনিই চীনের একমাত্র কণ্ঠশিল্পী যিনি চীনের তিনটা মহাকাব্যের একটির যাবতীয় চরণের জন্য সুর বেঁধে গাইতে পেরেছেন।
‘মানস’এর হানভাষার সংস্করণ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ।এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষ ইংরেজি, ফরাসী ও জাপানী ভাষায়ও অনুদিত হয়েছে । চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারী জুসুপু.মামাই সিনচিয়াংয়ের ‘ থিয়ান শান সাহিত্য পুরষ্কারের’ অন্তর্ভুক্ত প্রথম অবদান পুরষ্কার পেয়েছেন ।
লোক-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিত্বকারী রচনা হিসেবে ‘মানস’ কিরগিজ জাতির মানুষদের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁরা আজো বিশ্বাস করেন , এই মহাকাব্যের বীরেরা জীবিত আছেন । চীনা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্যের ইতাহাসে ‘মানস’ সুখ্যাতি অর্জন করেছে । জাতিসংঘ ১৯৯৫ সালকে বিশ্ব‘মানস’ বর্ষ বলে ধার্য করেছিল ।
|