মহাকাব্য ‘চিয়াংগের’

 

প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দি থেকে সপ্তদশ শতাব্দির প্রথম ভাগ পর্যন্ত মঙ্গোলীয় জাতি অধ্যুষিত ওয়েলাত অঞ্চলে মহাকাব্য ‘চিয়াংগের’ রচিত হয় । ওয়েলাত একটি প্রাচীন মঙ্গোলীয় উপজাতির নাম । ওয়েলাতের মানে বনাঞ্চলের উপজাতি ।এই উপজাতির মানুষরা প্রধানত: থাকত চীনের সিন চিয়াংয়ের আরতা পাহাড়ী অঞ্চলে । 

  চিয়াংগের এই মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র ।তাঁর বয়স যখন মাত্র দু বছর তখন্ হিংস্র আর নৃশংস মাংগুস তাঁর মাবাবাকে হ্ত্যা করে তাঁদের বাড়িঘর দখল করে । অনাথ চিয়াংগের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিন বছর বয়সে আরেনজান নামক স্বর্গীয় ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতে শুরু করেন এবং মাংগুসকে পরাজিত করেন । তাঁর বয়স সাত বছর পূর্ণ হতে না হতেই তিনি অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করেন। তাই পাওমুপা রাজ্যের প্রজা ও রাজকর্মকর্তারা তাঁকে সিংহাসনে বসালেন । কিন্তু মাংগুস পরাজয় স্বীকার না করে পাওমুপা রাজ্যের উপর আক্রমণের সুযোগ খুঁজে বেড়ায় । চিয়াংগের ৩৫জন শার্দুল- জেনারেল ও ৮০০০ নির্ভীক সেনা নিয়ে মাংগুসের আক্রমণকে ব্যর্থ করে সার্থকভাবে পাওমুপা রাজ্য রক্ষা করেন । তাঁর সুনাম দ্রুত ৪৪টি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্জয় অভিযানে সমস্ত শত্রুকে পরাস্ত করার পর চিয়াংগের অপূর্ব দক্ষতায় স্বর্গের মত এমন একটি দেশ প্রতিষ্ঠিত করেন যাতে তার প্রজারা চীরকাল জীবিত থাকেন , তাদের বয়স চীরকাল ২৫ বছর । তাঁর দেশে সারা বছরেই বসন্তকাল থাকে ,সর্বত্রই কলহাস্য ও ললিত গান শোনা যায় ।  

  এই মহাকাব্যে বলা হয়েছে , পাওমুপা রাজ্যে শীতকালও কনকনে হাওয়া নেই। সারা বছরই বসন্তকাল , সোনালী আলোয় চারদিক ঝলমল করতে থাকে।কোথাও দু:খবেদনা ও মৃত্যু নেই , অনাথ , বিধবা বা বিপত্নীক নেই ,শুধু ছিল ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি ; গোলোযোগ ও ত্রাস নেই ,শুধু ছিল সুখশান্তি ; পাহাড়ে বিরল বন্য জন্তু এবং তৃণভূমিতে গরু ,ভেড়া , ঘোড়া ও উটকে ছুটতে দেখা যায় । বাতাস স্নিগ্ধ ,ঝরঝরে বৃষ্টিসিক্ত মাটি উর্বর । 

  ‘চিয়াংগের’ মহাবীরের মহাকাব্য । এই মহাকাব্যের চরিত্রাঙ্কনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে । যেমন এই মহাকাব্যে বিশদভাবে বাল্যকালে নায়ক চিয়াংগেরের দুর্বিসহ জীবন ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা হয়েছে । তিনি যে সুদর্শন , বুদ্ধিমান , করিতকর্মা আর উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী ; প্রজাদের যে অকুণ্ঠ সমর্থন পেতেন এবং বিক্রমশালী বীর হিসেবে তিনি যে পাওমুপা রাজ্যের স্বার্থে কঠোর সংগ্রাম করেছেন তা জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই মহাকাব্যে ।  

  বীর হংগুর আরেকটি প্রাণবন্ত চরিত্র । এই মহাকাব্যে আবেগপূর্ণ ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে , হংগুরের মধ্যে ঘটেছে মঙ্গোলীয়দের ৯৯টি গুণ ও তৃণভূমির দু:সাহসীদের সমস্ত মহত্ চরিত্রের সমাবেশ । জনসাধারণের প্রতি তার বিশ্বস্ততা ছিল অসীম । ঈগলের ন্যায় তিনি সাহসিকতা ও অদম্য মনোবলের অধিকারী , পাওমুপা রাজ্যের জন্য তিনি সর্বদাই প্রাণবিসর্জন করতে প্রস্তুত , তাঁর মধ্যে মঙ্গোলীয় জাতির কষ্টসহিষ্ণুতা,দৃঢ়তা আর দুর্ধর্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় । এই মহাকাব্যে রঙ্গিন তুলি দিয়ে যে আরতাই পর্বতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রাচীনকালের ওয়েতলা উপজাতির বসতির পরিবেশ আঁকা হয়েছে তা মঙ্গোলীয় জাতির স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও সৌন্দর্যবোধের পরিচায়ক । এই মহাকাব্যের শিল্পকলার জাতীয় বিশিষ্টতা স্পষ্ট। অন্যান্য মহাকাব্যের মত এই মহাকাব্যের জাতীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে ভাষা ব্যবহারে । যেমন এই মহাকাব্যে ওয়েতলা উপজাতির শ্রুতিমধুর মৌখিক কথা ব্যবহৃত হয়েছে এবং সংলাপে মেশানো হয়েছে মঙ্গোলীয় জাতির প্রাচীন লোকসঙ্গীত , প্রার্থনা ,স্তুতি , সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভ বাণী , প্রবাদ ও প্রবচন।পটভূমির বর্ণনা , উপমা,অতিরঞ্জন প্রভৃতি অলংকারও বিপুল পরিমানে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন চিয়াংগেরের বিবাহ বিষয়ক অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি সবিনয়ে উনচল্লিশ জন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অবশেষে ষোল বছর বয়সী রাজকুমারী আকাইশাপুদালাকে বিয়ে করেন ।  

  ‘ চিয়াংগের ’ মঙ্গোলীয় জাতির প্রাচীন সাতিত্যাঙ্গনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রচনা । পরবর্তীকালীন সাহিত্যরচনার উপর তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।বর্তমানে এই মহাকাব্য চীন সরকারের প্রণীত গুরুত্বপূর্ণ চীনা সাহিত্যকর্মের নামের তালিকায় স্থান পেয়েছে ।