‘ রাজা গেসারের জীবনী’

       ‘ রাজা গেসারের জীবনী’ পৃথিবীর একমাত্র জীবিত মহাকাব্য । চীনের তিববত, অন্তমঙ্গোলিয়া , ছিনহাই প্রভৃতি অঞ্চলের শতাধিক লোকশিল্পী এখনো মহাবীর রাজা গেসারের মহান কীর্তির স্তুতি গাইছেন । 

  খ্রীষ্টপুর্ব দু-তিন শো’ বছর থেকে খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দি পর্যন্ত ‘ রাজা গেসারের জীবনী’ রচিত হয় । প্রায় এক হাজার বছরে লোকশিল্পীদের মুখে মুখে প্রচলিত হতে হতে ‘ রাজা গেসারের জীবনীর’ কাহিনী ও ভাষা ক্রমেই সমৃদ্ধ হয় । দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ‘ রাজা গেসারের জীবনী’ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় এবং তিববতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে । 

  ‘ রাজা গেসারের জীবনীর’ কাহিনী এমন: অনেক অনেক দিন আগে , তিববতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত ও দুষ্কৃতকারীদের জুলুম-জর্জরিত ছিল । দৈত্য-দানবের দাপটে স্থানীয় অধিবাসীদের দু:খবেদনার অন্ত ছিল না । করুণাময় বুদ্ধিসত্য --অবলোকিতেশ্বর দু:খ-পাথার থেকে মানুষদের মুক্ত করার জন্য বুদ্ধদেব --অমিতাভকে অনুরোধ করেন , অসুরদের দমন করার জন্য তিনি যেন দেবতার ছেলেকে মর্ত্যে পাঠান । দেবতার ছেলে থুইপাগেওয়া তিববতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে কালো চুলওয়া তিববতীদের রাজার অবতার নিলেন । তাঁর নাম হলো গেসার । এই মহাকাব্যে মহাবীর গেসার ছিলেন নৃ-দেব । তিনি সদ্গুণ-সম্পন্ন ও অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী । দৈত্য-দানব দমন আর জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের কর্তব্য তিনি যথার্থভাবে পালন করেন । গেসার মর্ত্য-লোকে জন্ম গ্রহণের পর পরই স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করার প্রয়াস চালান । তিনি অনেকবার চক্রান্তের শিকার হন । কিন্তু নিজের শক্তিবলে আর দেবতার রক্ষায় তিনি বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে সমস্ত পৈশাচিক দানবকে নিশ্চিহ্ন করেন । গেসারের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হতে না হতে তিনি ও তাঁর মা হোয়াংহো নদীর তীরে স্থানান্তরিত হন। তিনি বারো বছর বয়সে উপজাতির ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয় লাভ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন । তারপর তিনি দৈবশক্তি ব্যবহার করে অসুরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালান। মর্ত্যলোকের সমস্ত দানব পরাস্ত করে অপূর্ব কীর্তি স্থাপন করার পর তিনি মাতা আর রানীকে নিয়ে স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করেন । মহাকাব্যটির কাহিনী এখানে সমাপ্ত হয়। পরিমার্জিত ‘ রাজা গেসারের জীবনী’ ১২০ অধ্যায়ে বিভক্ত , এর শব্দসংখ্যা প্রায় দু কোটি , পঙক্তি-সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশী। বিশ্বের দীর্ঘতম মহাকাব্য হিসেবে তার শব্দ-সংখ্যা বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পাঁচটি মহাকাব্য ,অর্থাত্ প্রাচীন বাবিলনের প্রাচীন মহাকাব্য’‘ গিলগামেশ ’,গ্রীকের মহাকাব্য ‘ ইলিয়াড’ ও ‘ অডিসি’ এবং ভারতের মহাকাব্য ‘ রামায়ন ’ ও ‘ মহাভারত’ এর মোট শব্দ সংখ্যার চেয়েও অধিক ।  

   অনেক লোকসংগীত ,উপকথা ও গল্প ‘ রাজা গেসারের জীবনী’র উপজীব্য । এই মহাকাব্যের শতাধিক চরিত্রের মধ্যে দিকবিজয়ী বীর হোক বা নিষ্ঠুর রাজা হোক,পুরুষ হোক বা নারী হোক , বৃদ্ধ হোক বা তরুন হোক , সকলেই স্বতন্ত্র ব্যাক্তিত্বে উজজ্বল । ভাষার বিশিষ্টতা বিচার করে দেখা যায় , ‘ রাজা গেসারের জীবনী’তে ব্যবহৃত হয়েছে , তিববত জাতির পর্যাপ্ত প্রবাদ । তা ছাড়া উপমা-উতপ্রেক্ষা কোরাস, পুনরাবৃত্তি প্রভৃতি মৌখিক কাব্য সৃষ্টির বহু অর্থালঙ্কার এই মহাকাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ‘ হোলিং মহাযু্দ্ধ’ নামক অধ্যায়ে একজন রূপসী চিত্রিত হয়েছে এইভাবে : লিং রাজ্যের সুন্দরীর এক পা এগুনোর মূল্য একশোটি ঘোড়ার সমান ,এক পা পিছানোর মূল্য একশোটি ভেড়ার সমান , শীতকালে তিনি সুর্যের চেয়ে গরম , গ্রীষ্মকালে তিনি চাঁদের চেয়ে শীতল ।তাঁর শরীর ফুলের চেয়েও অধিক সুগন্ধী ।  

  ‘ রাজা গেসারের জীবনী’ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ বলে তার পরিমার্জন, অনুবাদ ও প্রকাশনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে চীন সরকার ।২০০২ সালে চীনে ‘ রাজা গেসারের জীবনী’ রচনার সহস্র বার্ষিকী বিপুল সমারোহে পালন করা হয় । এখন চীনের দশাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণালয়ে বহু পণ্ডিত এই বিরাটকায় মহাকাব্য নিয়ে গবেষণা করছেন ।