অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যভাগে ছিং রাজত্বকালের ঐশ্বর্যময় যুগে চীনের সাহিত্যাঙ্গনে যে একটি প্রসিদ্ধ উপন্যাস আবির্ভুত হয়েছে তাতে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তির আভাস দেওয়া হয়েছে এবং তার অগ্রীম শোক-সংগীত বাজানো হয়েছে । এই উপন্যাসের নাম ‘লাল ভবনের স্বপ্ন’ , লিখেছেন ছাও সিয়ে ছিন।
‘লাল ভবনের স্বপ্ন ’ চীনের ধ্রুপদী উপন্যাস- জগতের একটি স্মৃতি-ফলক । ছাও সিয়ে ছিন যে এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম লিখতে পেরেছেন তার মূলে ছিল তাঁর প্রতিভা আর সাহিত্য-অনুরাগ এবং তাঁর পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রা । ছাও সিয়ে ছিনের পিতামহ সম্রাট খাংশির বিশ্বস্ত পারিষদ । ছাও সিয়ে ছিনের কৈশোর কেটেছিল বিত্তবান পরিবারে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর পিতামহকে পদচ্যুত করা হয় এবং তাঁর পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় ।তাঁর পরিবার বাধ্য হয়ে দক্ষিণ চীন থেকে পেইচিংয়ে স্থানান্তরিত হয় । তরুণ বয়সে তিনি সমাজের ঔদাসিন্যের যথেষ্ট পরিচয় পেয়েছিলেন । বার্ধক্যে তিনি থাকতেন পেইচিংয়ের পশ্চিম উপকণ্ঠে । অভাব-অনটনের মধ্যে তিনি কষ্ট করে ‘লাল ভবনের স্বপ্নের ’ প্রথম আশি অধ্যায় রচনা করতে সক্ষম হন ।কিন্তু উপন্যাস শেষ করার আগে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন ।
‘লাল ভবনের স্বপ্ন ’এর আরেকটি নাম ‘ পাথরের কাহিনী’ । জীবদ্দশায় এই উপন্যাস লেখা যখন শেষ হয় নি তখন তার পাণ্ডুলিপি চীনাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে । ছাও সিয়ে ছিনের মৃত্যুর পর গাও এ নামে একজন বুদ্ধিজীবী লেখকের রচনাশৈলীর অনুকরণে বাকি চল্লিশ অধ্যায় লিখে উপন্যাসটি সমাপ্ত করেন ।
‘লাল ভবনের স্বপ্ন ’ চীনা সমাজের বিশ্বকোষধর্মী উপন্যাস । এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো সমসাময়িক সমাজের প্রায় সকল মহলের ।তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছে রাজপরিবারের সদস্য , সম্ভ্রান্ত রাজকর্মকর্তা ও আমলা তেমনই রয়েছে পরিচারক-পরিচারিকা, সন্ন্যাসী , বণিক ও কৃষক । উচ্চ স্তরের আদব-কায়দা, দেখা-সাক্ষাত ,উদযাপনী অনুষ্ঠান আর অন্ত্যেষ্টিক্রীয়া থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বাড়ি নির্মান , নিত্যব্যবহার্য্য দ্রব্য তৈরী , ফুল চাষ , বৃক্ষরোপন , চিকিত্সা ও নাচগান পর্যন্ত ছিং রাজত্বকালের যাবতীয় মহলের লোকদের বিচিত্র জীবন চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে।
ছাও সিয়ে ছিন তাঁর উপন্যাসে সমাজের ছবি দেখানোর জন্য প্রথমে রাজপরিবারের সদস্যদের উপর দৃষ্টিপাত করেন । তার পর তাঁর দৃষ্টি চিয়া পরিবার , সি পরিবার ,ওয়াং পরিবার আর সিয়ে পরিবারের উপরে গিয়ে পড়ে । অবশেষে তিনি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন চরিত্রগুলোর জীবন-কেন্দ্র -- চিয়া পরিবারের তাগুয়ান বাগানের উপর । বহু নারী বিশেষ করে তরুনী ও কিশোরীদেরকে প্রধান অঙ্গ করে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র সমাজ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে এই ক্ষুদ্র সমাজের সম্বন্ধের অঙ্কনে প্রতিফলিত হয়েছে সমগ্র বিশ্ব । সেই সঙ্গে বিধৃত হয়েছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী চিয়া পরিবারের অবক্ষয়ের গতিধারা ।
‘লাল ভবনের স্বপ্ন ’এর চরিত্রায়ন সার্থক হয়েছে ।এই উপন্যাসের চরিত্র-সংখ্যা সাতশোরও বেশী । প্রধান চরিত্রের সংখ্যা একশোর কাছাকাছি । ছাও সিয়ে ছিন নারীদের বিশেষ করে তরুণী ও কিশোরীদের স্পর্শকাতর ,জটিল আর পরিবর্তনশীল হৃদয়-লোক ও মনোবৃত্তি সঠিকভাব অনুধাবন করতে পেরেছেন । গভীর দরদে তিনি তাঁদের সুখী জীবন যাপনের আকাংক্ষা বিশেষ করে তাঁদের প্রেম- পিপাসা রুপায়িত করেছেন । তাঁদের রহস্যময় আর নিগূঢ় মনুষ্যত্ব রূপ লাভ করায় এবং তাঁদের উপরে পরিবেশ ও সমাজের শাসন ও প্রভাব জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলায় তাঁদের শৈল্পিক চরিত্র হয়েছে নিরেট আর প্রাণবন্ত ।
‘লাল ভবনের স্বপ্ন ’এর ভাষা, কাঠামো ও চরিত্রায়ন চীনের ধ্রূপদী- সাহিত্যাঙ্গনের শৃঙ্গে উন্নীত হয়েছে। তার শিল্প-মূল্য বিচার-বিশ্লেষণের অন্ত নেই ।
|