তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী

       প্রাচীন ধ্রূপদী সাহিত্যকর্ম ‘ তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী ’ চীনে সর্বজনবিদিত । ‘ তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী ’ তে যে প্রচন্ড যুদ্ধের দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে , যে সব প্রাণবন্ত চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে , এবং বুদ্ধি আর শক্তি প্রয়োগের যে সরস কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তা শতাব্দির পর শতাব্দি চীনা জনসাধারণের কাছে সমাদৃত হয়েছে । চীনের বহু পন্ডিত দীর্ঘকাল ধরে এই উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং করছেন । 

  চতুর্দশ শতাব্দিতে এক পন্ডিতের পরিবারে এই উপন্যাসের লেখক লুও কুয়ান চংয়ের জন্ম । ছোটবেলায় তিনি গভীর আগ্রহে যে নানা ধরনের প্রচুর বই পড়েছিলেন তা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির জন্য মজবুত ভিত্তি স্থাপন করেছিল । তিনি যে যুগে থাকতেন সেই যুগে জাতীয় দ্বন্দ্ব অত্যন্ত তীব্র ও জটিল আকার ধারণ করেছিল । মঙ্গোলিয় অভিজাত সম্প্রদায় ইউয়ান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করে হান জাতির উপর যে অসহ্য জুলুম চালাত তার প্রতিরোধে হান জাতির জনসাধারণ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন । চীনের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে । বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী বাহিনী সাহসের সঙ্গে রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । ইউয়ান রাজত্ব উত্খাত নতুন রাজত্ব গড়ে তোলার আশায় বিদ্রোহী বাহিনীগুলো পরস্পরকে গ্রাস করে । তরুণ বয়সে লুও কুয়ান চং একটি বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্টাফের দায়িত্ব পালন করতেন ।তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল : গোলযুগপূর্ণ যুগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে সিংহাসনে আরোহণ করা এবং চীনদেশকে শাসন করা । কিন্তু জু ইউয়ান চাংয়ের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনী অবশেষে বিজয় লাভ করে এবং মিং রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করে । রাজনৈতিক স্বপ্ন মিলিয়ে যাওয়ার পর লুও কুয়ান চং গ্রামে ফিরে সাহিত্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন।  

  ‘তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী ’তে ১৮৪ থেকে ২৮০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় একশো বছরের সুদীর্ঘ জটিল ঐতিহাসিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ।এই উপন্যাস রচনার জন্য লুও কুয়ান চং তিনটি রাজ্যের পর্যপ্ত প্রবন্ধ ,জনশ্রুতি,কিংবদন্তী ও লোককাহিনী সংগ্রহ করেন। ওয়েই রাজ্য , সু রাজ্য ও উ রাজ্যের মধ্যকার সামরিক সংগ্রামের ইতিহাস এই উপন্যাসে জীবন্তভাবে বিধৃত হয়েছে । এই উপন্যাসের কাহিনীতে লুও কুয়ান চংয়ের রাজনৈতিক বাসনা ও কৃষকদের বিদ্রোহী বাহিনী যোগদানের ইতিবৃত্তও মেশানো রয়েছে ।  

   ‘তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী ’র শৈল্পিক কীর্তি বহমুখী । লেখক রোমাঞ্চকর রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রাম বর্ণনা করেছেন এবং নানা রকম শিল্প-শৈলীতে সার্থকভাবে বহু উজ্জ্বল আর পূর্ণতাপ্রাপ্ত চরিত্র সৃষ্টি করেছেন । মোট চার শতাধিক চরিত্রের মধ্যে বিশ-তিরিশটি প্রধান চরিত্রের স্বতন্ত্র প্রকৃতি বিশদভাবে চিত্রিত করা হয়েছে । যেমন ওয়ে রাজ্যের রাজা চাও ছাও যিনি রণকৌশল প্রয়োগে পটু , কিন্তু সন্দেহপ্রবণ আর চতুর ; সু রাজ্যের সামরিক উপদেষ্টা চু গে লিয়াং যিনি অনন্য রণবিশারদ ও প্রগাড় বিদ্যার অধিকারী ; সু রাজ্যের খ্যাতনামা দুর্দান্ত জেনারেল চান ফেই যিনি বাহ্যত: অসতর্ক ,কিন্তু কাজে সাবধানী; উ রাজ্যের মার্শাল চৌ ইয়ু যিনি বিজয়-পিয়াসী, উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী , কিন্তু সংকীর্ণমনা ,তাঁরা সবাই জনপ্রিয় চরিত্র ।  

  ‘তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী ’তে রয়েছে অসাধারণ শিল্প মুল্য। এছাড়া এই উপস্যাসকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিশ্বকোষধর্মী রচনাও বলা যায় । সমসাময়িক সমাজের যাবতীয় মহলের চিত্র এই উপন্যাসে পরিলক্ষিত ।চীনে অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিত এই বিরাটকায় গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা করছেন । তাঁরা ইতিহাস , প্রতিভা বিষয়ক বিদ্যা , মনস্তত্ত্ব , গণ-সম্পর্ক , কৌশল-বিদ্যা, ব্যবস্থাপনা , রণবিদ্যা , শিল্পকলা আর নীতিশাস্ত্রের দিক থেকে এই উপন্যাসের সাংস্কৃতিক মূল্য ও বাস্তব তাত্পর্য অনুধাবনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন । 

   ‘তিন রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী ’ অন্যান্য দেশের জনগণের কাছেও সমাদৃত হয়েছে । এই উপন্যাস বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং তা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে । বিদেশে এই উপন্যাসকে গণ- প্রকৃতি সম্পন্ন একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।