পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ 

       চীনের প্রাচীনকালের ইতিহাসে “ পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” একটি সর্বাপেক্ষা সফলকাম পৌরাণিক উপন্যাস ।সপ্তম শতাব্দিতে বৌদ্ধশাস্ত্র শিখার জন্য ভারতে যাওয়া চীনের বিখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙকে অবলম্বন করে “ পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” রচনা করা হয়েছে ।থাংসেং ও তাঁর তিনজন শিষ্য এই উপন্যাসের চারটি প্রধান চরিত্র । বৌদ্ধশাস্ত্র বয়ে আনার পথে তাঁদের যে কল্পনাতীত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে হয়েছে এই উপন্যাসে সুললিতভাষায় তা বর্ণনা করা হয়েছে ।থাংসেংয়ের বড় শিষ্য সুন উ খং একটি করিতকর্মা বানর , সে কোনো শাসককে ভয় করে না এবং অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করত । সমাজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠার জন্য লেখক যে স্বপ্ন দেখতেন তা তির্যকভাবে এই উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে । 

  চীনের জিয়াংসু প্রদেশের হুয়াই আনে লেখক উ ছেন এনের জন্ম । তিনি ছোটোবেলায় বুদ্ধিমান ছিলেন । বহু ক্ষেত্রে তাঁর শখ ও দক্ষতা ছিল । তিনি চিত্রাঙ্কন , লিপিকলা ও ওয়ে ছি নামক দাবা খেলায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি কবিতা লিখতে ও গানের সুর বাঁধতে পছন্দ করতেন । গুণীজ্ঞানীদের লেখা চীনা শব্দ ও আঁকা ছবি সংরক্ষণ তাঁর অন্যতম শখ ছিল। কৈশোরে সুন্দর প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি জন্মস্থানে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের প্রশংসা পেয়েছিলেন। কিন্তু রাজপরীক্ষায় তিনি বারবার অকৃতকার্য হয়েছিলেন । তিনি অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতেন । পরিবারের দুরবস্থার দরুণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক সরকারের দুর্নীতি এবং সামাজিক ঔদাসীন্য গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছেন । সেই সঙ্গে তাঁর মনে রোপিত হয়েছে ক্ষোভ ও প্রতিরোধের বীজ । তিনি তাঁর একটি কবিতায় এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে , শাসকরা যে প্রতিভাবানদের পরিবর্তে অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণপদে নিযুক্ত করেন তার ফলে সমাজে ধীরে ধীরে ঘুণে ধরে। সমাজের অন্ধকার ঘুচানোর প্রবল অভিপ্রায় তাঁর ছিল।কিন্তু তাঁর সামর্থ্যকে কাজে লাগানোর সুযোগ না পাওয়ায় বৃথা দীর্ঘ শ্বাস ফেলা ছাড়া তাঁর কোনো উপায় ছিল না । তাঁর ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং শুভ আকাংক্ষা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর উপন্যাস “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণে” । তিনি বার্ধক্যে “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” শেষ করলেও সারা জীবন তিনি এই উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ।ছোটোবেলায় উ ছেন এনে মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে হুয়াই আনের উপকণ্ঠের জঙ্গল ও প্রাচীন মন্দিরে বেড়াতে যেতেন। বাবা তাঁকে হুয়াই আনে প্রচলিত অনেক চিত্তাকর্ষক উপকথা শুনাতেন । তাই তাঁর অদ্ভুত গল্প শোনার শখ জন্মেছে । বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই শখও বাড়তে থাকে । তাঁর বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হতে না হতেই তিনি প্রচুর কিংবদন্তী ও জনশ্রুতি সংগ্রহ করেন । উপন্যাস রচনার ইচ্ছাও তখন তাঁর মনে জেগেছিল । ৫০ বছর বয়সে তিনি “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ”এর প্রথম দশাধিক অধ্যায় লিখেছিলেন। নানা কারণে “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” লেখা একাধিক বছর বন্ধ ছিল । বার্ধক্যে রাজসরকারের কর্মকর্তাপদে ইস্তফা দিয়ে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” শেষ করতে সক্ষম হন । 

   “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ”এর এক একটা অধ্যায়ই এক একটা ছোটো গল্প।তবে স্বতন্ত্র গল্পগুলো যোগসুত্রে আবদ্ধ । গল্পে বর্ণিত দেবতা ও দৈত্য যথাক্রমে ন্যায় ও অন্যায়ের প্রতীক । লেখক উপন্যাসে যে একটা বিচিত্র পৌরাণিক জগত সৃষ্টি করেছেন তার সর্বত্রই মর্ত্যের ছায়া দৃষ্টিগোচর হয় । যেমন স্বর্গ দেখতে মহিমান্বিত ,কিন্তু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নিতান্তই নির্বোধ , ভালোমন্দ বিচার করতে অপারগ । স্বর্গ ও মর্ত্যের রাজবংশের রয়েছে অসম্ভব সাদৃশ্য । ভয়াল নরকে রাজকর্মচারী পরস্পরের ভুলত্রুটি লুকিয়ে ঘুষ খেয়ে আইন লংঘন করে । নিরীহ মানুষদের বিরূদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় । এর সঙ্গে পৃথিবীর রাজদরবারের মিল আছে । দৈত্য -দানব মানুষকে হত্যা করে খেয়ে ফেলে ,ধন-সম্পত্তি ও সুন্দরীদের প্রতি তাদের তৃষ্ণার সীমা নেই । মায়া-বিদ্যা ও মন্ত্র-বলের সাহায্যে অধিপতি হওয়ার পর এমন কুকর্ম নেই যা তারা করে নি । বস্তুত: তারা মর্ত্যলোকের অসত ভূস্বামী ও আমলাদের অবতার ।বীর-বানর সুন উ খং “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” এর প্রধান চরিত্র । দুর্জয় দুর্বার বানর সুন উ খং দুষ্কৃতকারীদের তীব্রভাবে ঘৃণা করে । তার অজেয় অস্ত্র-- লোহার লাঠির আঘাতে কোনো কোনো দৈত্য প্রাণ হারায় , কোনো কোনো দৈত্য জখম হয়ে আত্মসমর্পন করে। সমাজের অন্যায়-অবিচার আর অশুভ শক্তি নির্মূল করার জন্য লেখক উ ছেন এনের প্রবল আকাংক্ষা এই উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে । 

  পরবর্তী যুগের উপর “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ” এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর । গত কয়েক বছরে “পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রমণ”ছিল চীনের শিশু সাহিত্যকর্ম, চলচ্চিত্র,টিভি নাটক ও নাটক সাহিত্যের অফুরন্ত উত্স ।