ফু শং লিং ও তাঁর “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প”

       অষ্টাদশ শতাব্দিতে চীনে “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প” নামেএকটি ছোটো গল্প সংকলন দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।গল্পকার ফু শং লিং স্বতন্ত্র রচনাশৈলিতে এই বইতে বহু শিয়াল-দেবীর কাহিনী বর্ণনা করেছেন । 

  ফু শং লিং (১৬৪০-১৭১৫) ছিলেন চীনের ছিং রাজত্বকালের সাহিত্যিক । বণিকের পরিবারে তাঁর জন্ম ।তিনি শিক্ষকতা করে জীবিকানির্বাহ করতেন এবং বহু সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন । “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প” তাঁর প্রতিনিধিত্বকারী রচনা । 

  “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প” এ আছে ৪৩১টি ছোটো গল্প। কোনো কোনো ক্ষুদ্র গল্পের চীনা শব্দসংখ্যা মাত্র দু-তিন শো । বড় বড় গল্পের চীনা শব্দসংখ্য কয়েক হাজার । বইটিতে শিয়াল-দেবী ও ভূতের কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে আড়ষ্ট সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতি ও রাজপরীক্ষার পচনশীল প্রথার সমালোচনা করা হয়েছে এবং স্বাধীন ব্যক্তিত্বের কীর্তন করা হয়েছে ।বইটির প্রেমের গল্প পড়তে পাঠকদের সবচেয়ে ভালোলাগে ।এই সব প্রেমের গল্পে ভূত ও শিয়াল-দেবীর সঙ্গে মানবের প্রণয়কাহিনী বর্ণনায় তরুণতরুনীদের সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতির বন্ধন ভাঙার ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে । 

  “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প”এ অধিকাংশ শিয়াল-দেবী সুন্দর আর দয়ালু কিশোরীর চেহারা ধারন করে আবির্ভুত হয় । “ শিয়াও ছুই” নামক গল্পের নায়িকা শিয়াও ছুই সর্বাপেক্ষা হৃদয়গ্রাহী ।এই গল্পের ঘটনা-বিন্যাস জটিল ও চিত্তাকর্ষক । লেখক ফু শং লিং অসাধারণ কৌশলে যে একটি সরল , দয়ালু ও বুদ্ধিমান কিশোরীর চরিত্র নির্মান করেছেন তা পাঠকদের মন হরণ করেছে । গল্পটির উপসংহারে শিয়াও ছুইয়ের আসল পরিচয় জানা যায় ।প্রকৃত প্রস্তাবে শিয়াও ছুই ছিল একটি শিয়াল-দেবী । তার মা ওয়াংথাই ছাংয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছে । কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য সে সুন্দরীর চেহারায় রুপান্তরিত হয়ে ওয়াংথাই ছাংয়ের বাড়িতে এসেছে । 

  “ শিয়ালের মেয়ের বিয়ে ” নামক গল্পে শিয়ালের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হয়েছে ।শিয়াল পরিবারের সবাই নম্র ও অতিথিপরায়ন।তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়া মানুষদেরকে বন্ধুভাবাপন্ন সম্মানিত অতিথি বলে গণ্য করে এবং তাদের আপ্যায়নের চেষ্টার ত্রুটি করে নি ।এই প্রীতিপূর্ণ গল্প পড়ে পাঠকরা ভুলে যায় বাস্তব জীবনের গ্লানি ও দু:খবেদনা। 

  সুন্দর শিয়াল ছাড়া বিশ্রী ও দয়ালু শিয়ালও “ নির্জন কুঞ্জের বিচিত্র গল্প”এর কোনো কোনো গল্পের নায়িকা। 

  “ কুতসিত শিয়াল” নামক গল্পে একটি কুতসিত শিয়াল একদিন একজন গরীব বুদ্ধিজীবীর দেখা পায় এবং অভাব অনটন কাটিয়ে উঠতে তার পরিবারের সবাইকে আর্থিক সাহায্য দেয় । প্রচুর পোষাক পাওয়া ও আরামদায়ক নতুন বাড়ি নির্মান করার পর সেই বুদ্ধিজীবী মন্ত্র পড়ে বাড়ি থেকে কুতসিত শিয়ালকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য একজন জাদুকরকে আমন্ত্রণ জানায় ।সেই বুদ্ধিজীবীর অকৃতজ্ঞতায় ক্ষুব্ধ হয়ে কুতসিত শিয়াল সেই বুদ্ধিজীবীকে যা দিয়েছে তা সবই ফিরিয়ে নেয় । তারপর প্রকাণ্ড দৈত্যের মুর্তি ধারন করে তাকে সাজাও দেয় । লেখকের এই গল্পে মানবজাতির দুরাচারের নিন্দা করা হয়েছে ।“ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুতগল্প” এ সুশ্রী আর নৃশংস শিয়ালও দৃষ্টিগোচর হয় ।“ মানুষের চামড়া ” নামক গল্পে একটি শিয়াল মানুষের মসৃন চামড়া পরে মানুষের রক্ত চোষে দিনপাত করে।অবশেষে মানুষদের লাঠির আঘাতে তার মৃত্যু হয় । 

  মোটের উপর বলা যায় , ফু শং লিংয়ের “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প”এ শিয়াল-দেবীর নামে যে অনেক নারী- চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের এমন কতকগুলো সদগুণ আছে যা মানবজাতির মধ্যে নেই। 

  চীনের সাহিত্যের ইতিহাসে “ নির্জন কুঞ্জের অদ্ভুত গল্প” একটি অমর গ্রন্থ । গত দু’শতাধিক বছরে তা বিশাধিক ভাষায় অনুদিত হয়ে সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ।তার একাধিক গল্পের অবলম্বনে চলচ্চিত্র বা টিভি নাটক তৈরী করা হয়েছে এবং দর্শকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে ।